মিরপুরের পানিতে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে ওপারে পাড়ি জমিয়েছেন বাবা-মা। ভাগ্যক্রমে ছেলে হোসাইন ফিরে আসলেও বেঁচে নেই তার মা-বাবা ও বড় বোন। এখন সবকিছুই অচেনা লাগে ৭ মাসের শিশু হোসাইন এর কাছে, খুঁজে ফিরে তার মাকে। কাউকেই চিনতে পারে না সে। মায়ের গায়ের সেই ঘ্রাণ খুঁজে বেড়াচ্ছে সব যায়গায়। ঘুম ছাড়া বাকি সময়টা কাটছে তার আতঙ্কে, বার বার চিৎকার দিয়ে কেঁদে উঠছে শিশুটি।
বৃহস্পতিবার (২১ সেপ্টেম্বর) রাতে রাজধানীর মিরপুরে ঢাকা কমার্স কলেজ সড়কে সিরাজিয়া ইসলামিয়া মাদ্রাসার পাশে বৃষ্টির পানিতে বিদ্যুতায়িত হয়ে মৃত্যু হয় শিশু হোসাইনের মা-বাবা-বোনসহ চারজনের।
নিহতরা হলেন- হোসাইনের বাবা মো. মিজান (৩০), মা মুক্তা বেগম (২৫) ও বোন সাত বছরের লিমা এবং অটোরিকশাচালক অনিক মিয়া (২১)। মিজানদের উদ্ধার করতে গিয়ে বিদ্যুতায়িত হয়ে প্রাণ দেন এই তরুণ। এর আগেই মা মুক্তার কোল থেকে ছিটকে পড়ে বেঁচে যায় শিশু হোসাইন। শিশুটি পানিতে হাবুডুবু খাচ্ছিল। তখন তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নেয়া হয়।
স্বজনরা জানান, মিরপুরে চিড়িয়াখানা রোডে মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্সে একটি বাসায় স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে বাস করতেন মিজান। কখনও ফেরি করে লেবুর শরবত বিক্রি করতেন আবার কখনও বাসের হেলপারি করতেন তিনি। কিছুদিন আগে স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে মিজান গ্রামের বাড়ি ঝালকাঠিতে বেড়াতে গিয়েছিলেন। বৃহস্পতিবার সকালে ঢাকায় ফেরেন। দুপুরে ঝিলপাড় বস্তিতে শাশুড়ির বাসায় স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে দাওয়াত খেতে যান তিনি। রাত পৌনে ১০টার দিকে বৃষ্টির সময় চিড়িয়াখানা রোডের বাসায় ফেরার উদ্দেশে বের হন। তখন প্রচণ্ড বৃষ্টিতে সড়কে জলাবদ্ধতা তৈরি হয়। সাত মাসের ছেলে হোসাইন ছিল মায়ের কোলে। আর সাত বছরের মেয়ে লিমা বাবার হাত ধরে পানির মধ্যে হাঁটছিল। তখনই তারা ফুটপাতের পানিতে বিদ্যুতায়িত হন।
হোসাইনের মামা সাদ্দাম হোসেন আরিফ দুর্ঘটনাস্থল থেকে প্রায় ২৫ গজ দূরের আমির স্টোর নামে একটি হার্ডওয়্যার দোকানের কর্মচারী। তিনি বলেন, আমার ভাগনেই যে পানিতে ভাসছিল তা আমি প্রথমে বুঝিনি। দেখি পানিতে একটা বাচ্চা হাবুডুবু খাচ্ছে। কোলে তুলে দেখি আমারই ভাগনে। তখন তাকে দ্রুত একজনের কাছে দিই হাসপাতালে নেয়ার জন্য। ছোট্ট ভাগনেকে বাঁচাতে পারলেও দুলাভাই-বোন আর আরেক ভাগনিকে বাঁচাতে পারিনি।
বর্তমানে শিশু হোসাইন সেই বস্তিতে আমেনা বেগম নামে এক নারী তত্ত্বাবধানে রয়েছে। আমেনা বেগম বলেন, আল্লাহ শিশুকে বাঁচিয়ে দিয়েছেন। হোসাইনকে এখন আমার কাছেই রেখেছি। পুলিশও বলেছে রাখতে। পরে তাকে তার আত্মীয়-স্বজনের কাছে বুঝিয়ে দেব।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯ ও ডেসকোর হটলাইনে ফোন করে বিষয়টি জানানো হয়। তাদের অভিযোগ, ডেসকোকে ফোন করে ঘটনা জানিয়ে বিদ্যুতের লাইন বন্ধ করে দেওয়ার অনুরোধ করলেও অন্তত ২০ মিনিট পর বন্ধ করা হয়। এ ছাড়া ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি পৌঁছেছে হতাহতদের উদ্ধার করে হাসপাতালে নেওয়ার পর।
ডেসকোর ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাওসার আমীর আলী বলেন, ধারণা করা হচ্ছে চোরাই লাইনে লিকেজ থেকে এই দুর্ঘটনা ঘটেছে। প্রতিনিয়ত ওই বস্তি এলাকায় অবৈধ লাইনের বিরুদ্ধে অভিযান চালানো হয়। অনেক সময় তার কেটে দেয়া হয়।
মিরপুর থানার ওসি মোহাম্মদ মহসীন বলেন, চারজনের মৃত্যুর ঘটনায় শুক্রবার থানায় মামলা হয়েছে। অবহেলাজনিত কাজের কারণে মৃত্যু হয়েছে- এমন অভিযোগ আনা হয়েছে এজাহারে। মৃত অনিকের বাবা বাবুল মিয়া এই মামলা করেন।