ভারতে করোনা পরিস্থিতি ক্রমেই ভয়াবহ হচ্ছে। বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যা ও মৃত্যু। গত শুক্রবার দেশটিতে তিন লাখ ৪৫ হাজার ১৪৭ জন আক্রান্ত ও দুই হাজার ৬২১ জন মারা যান। এ নিয়ে তিন দিনে ভারতে আক্রান্তের সংখ্যা ছাড়িয়েছে ১০ লাখ এবং মারা গেছেন সাড়ে ছয় হাজারের বেশি মানুষ। অক্সিজেনের অভাবে দিল্লির এক হাসপাতালে মারা গেছেন ২৫ জন। অভিযোগ উঠেছে, অক্সিজেন সরবরাহে বাধা দেওয়া হচ্ছে। এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে দিল্লি হাইকোর্ট বলেছেন, কেউ অক্সিজেন সরবরাহে বাধা দিলে তাকে ফাঁসি দেওয়া হবে।
হাসপাতালে অক্সিজেন সংকট ও চিকিৎসার জন্য হাহাকারের চিত্র দিল্লিসহ মহারাষ্ট্র, উত্তর প্রদেশ, গুজরাটসহ বিভিন্ন রাজ্যে একই রকম। গতকালও দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল কেন্দ্র সরকারের কাছে অক্সিজেন দেওয়ার আবেদন জানিয়েছেন। করোনায় মরদেহ দাহ করতে হিমশিম খাচ্ছে শ্মশান কর্তৃপক্ষ। কিছু কিছু শ্মশানে চিতার আগুন নিভছেই না। এ অবস্থায় বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মৃতের প্রকৃত সংখ্যা সরকার আড়াল করছে অথবা এড়িয়ে যাচ্ছে।
গতকাল নিউইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশ্বে দৈনিক করোনায় আক্রান্তের প্রায় অর্ধেকই এখন এককভাবে ভারতের মানুষ। তবে যে সংখ্যা দেখানো হচ্ছে, তা প্রকৃত সংখ্যার চেয়ে অনেক কম। আক্রান্তের মধ্যে অনেকেই ঘর থেকে বের হচ্ছেন না। হাসপাতালে বেড নেই, চিকিৎসকের দেখা পাওয়া যাচ্ছে না।
করোনার ‘নতুন ভারতীয় ধরন’ খুবই সংক্রামক বলে ধারণা করা হচ্ছে। যে কারণে আক্রান্তের সংখ্যা হুহু করে বাড়ছে। ওয়ার্ল্ডওমিটারের তথ্য অনুযায়ী, ভারতে এ পর্যন্ত মোট মৃতের সংখ্যা এক ৮৬ হাজার ৯২৮। সরকারি হিসাব থেকে এ তথ্য দিয়েছে ওয়ার্ল্ডওমিটার। তবে নিউইয়র্ক টাইমস বলছে, যেখানে প্রতিদিন এত বেশি মানুষ মারা যাচ্ছে, সেখানে মোট মৃত্যুর এই সংখ্যা সন্দেহজনক।
নিউইয়র্ক টাইমস ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে শ্মশানে কর্মরত ব্যক্তিদের সাক্ষাৎকার নিয়েছে। এসব শ্মশানে চিতার আগুন নিভছেই না। করোনায় মারা যাওয়া যত মরদেহ শ্মশানে দাহ করা হচ্ছে, তা থেকে বোঝা যায়, মৃতের প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি। বিশ্নেষকরা বলছেন, কিংকর্তব্যবিমূঢ় রাজনীতিক ও স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ মৃতের বিশাল সংখ্যা লুকিয়ে অথবা এড়িয়ে যাচ্ছেন। এমনও দেখা যাচ্ছে, শোকাহত অনেক পরিবার করোনা সংক্রমণের তথ্য লুকিয়ে যাচ্ছে।
ভারতের ওপর নিবিড় পর্যবেক্ষণ রাখা ইউনিভার্সিটি অব মিশিগানের মহামারি বিশেষজ্ঞ ভ্রমর মুখার্জি বলেছেন, ‘একে তথ্য-উপাত্তের ধ্বংসযজ্ঞই বলা যায়। আমরা যেসব মডেল নিয়ে কাজ করছি, তাতে এটি পরিস্কার- যে সংখ্যা দেখানো হচ্ছে, প্রকৃত সংখ্যা তার চেয়ে তিন থেকে পাঁচ গুণ।’
গুজরাটের আহমেদাবাদে একটি বিশাল শ্মশান প্রাঙ্গণের চিত্র তুলে ধরেছে নিউইয়র্ক টাইমস। বলা হচ্ছে, দিন-রাত ২৪ ঘণ্টাই সেখানে সারা সারি চিতা জ্বলছে। উজ্জ্বল কমলা আগুনে আলোকিত হচ্ছে রাতের আকাশ। মনে হচ্ছে, শিল্প-কারখানার মতো বিরতিহীন জ্বলেই চলেছে।
সুরেশ ভাই নামে সেখানকার এক কর্মী জানান, মরদেহের নিরবচ্ছিন্ন এই দীর্ঘ লাইন তিনি আর কখনও দেখেননি। তবে তার হাতে থাকা পাতলা কাগজে মৃত্যুর কারণ হিসেবে তিনি করোনা সংক্রমণের কথা লিখছেন না। যদিও এই কাগজই তিনি শোকাহত পরিবারকে দিচ্ছেন। তাহলে কাগজে মৃত্যুর কী কারণ লিখছেন তিনি। সুরেশ ভাই বলেছেন, ‘সিকনেস, (অসুস্থতা), সিকনেস, সিকনেস। এটিই লিখে দিচ্ছি আমরা।’ কেন এমনটি লিখছেন- জানতে চাইলে তিনি বলেন, তার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এটি লিখতে বলেছেন। তবে এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ঊর্ধ্বতনরা কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লি ও আরেক বড় শহর ভোপালের চিত্র খুবই নাজুক। ভোপালের সব শ্মশান রাতদিন ব্যস্ত। ১৯৮০-এর দশকে সেখানে গ্যাস বিস্ম্ফোরণে কয়েক হাজার মানুষ মারা যান। বাসিন্দারা বলছেন, ওই বিপর্যয়ের পর এই প্রথম শ্মশানগুলো এত বেশি ব্যস্ত দেখা যাচ্ছে। মধ্য এপ্রিলের ১৩ দিন ভোপালের কর্মকর্তারা ৪১ জনকে করোনায় মৃত দেখিয়েছেন। তবে একই সময়ে নিউইয়র্ক টাইমসের এক জরিপে ভোপালের প্রধান শ্মশানে দাহ করা মরদেহের সংখ্যা কমপক্ষে এক হাজার। ভোপালের কার্ডিওলজিস্ট জি.সি. গৌতম বলেছেন, ‘অনেক মৃত্যুর রেকর্ড রাখা হচ্ছে না এবং দিন দিন এ সংখ্যা বাড়ছে।’
এনডিটিভির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত শুক্রবার রাতে জয়পুর গোল্ডেন হাসপাতালে অক্সিজেনের অভাবে ২৫ করোনা রোগীর মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছেন হাসপাতালটির মেডিকেল ডিরেক্টর ডা. ডি কে বালুজা। গতকাল তিনি জানান, ‘আমরা সরকারের কাছ থেকে ৩ দশমিক ৫ টন অক্সিজেন বরাদ্দ পেয়েছি। বিকেল ৫টা নাগাদ তা আমাদের কাছে পৌঁছানোর কথা ছিল। তবে এ অক্সিজেন এসেছে মধ্যরাতের দিকে। সে সময় পর্যন্ত ২৫ রোগীর মৃত্যু হয়েছে।’
লাশের এ মিছিল সামলাতে পারছে না দিল্লির শ্মশানগুলো। স্বজনের মৃতদেহ সৎকারের জন্য আসা পরিবারগুলোকে তারা অপেক্ষা করতে অনুরোধ জানাচ্ছে। দিল্লির নিরুপায় হাসপাতালগুলো জরুরি ভিত্তিতে অক্সিজেন আর চিকিৎসা উপকরণের বাড়তি বরাদ্দের আদেশ চেয়ে এ সপ্তাহেই হাইকোর্টে গিয়েছিল। সেই আবেদন শুনে দিল্লি হাইকোর্ট কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের কাছে জানতে চেয়েছেন- এই ‘সুনামি’ সামাল দিতে তারা কীভাবে সক্ষমতা বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে। একই সঙ্গে নির্দেশ দিয়েছেন- যেখান থেকে যেভাবে হোক অক্সিজেন সরবরাহ করা হোক।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছে, করোনাভাইরাস কী ঘটাতে পারে- ভারত ভয়ংকরভাবে তার জানান দিচ্ছে। উত্তর ভারতে কয়েক ডজন হাসপাতাল পরিচালনা করে ম্যাক্স হেলথকেয়ার। শনিবার ম্যাক্স হেলথকেয়ার কর্তৃপক্ষ এক টুইটে জানায়, তাদের কাছে অক্সিজেনের যে মজুদ আছে, তা দিয়ে দুই ঘণ্টাও চলবে না।
ভারতের আরেক বড় হাসপাতাল চেইন ফর্টিস হেলথকেয়ার বলেছে, দিল্লিতে তারা আর নতুন রোগী ভর্তি করতে পারছে না। সকাল থেকে তারা অক্সিজেন সরবরাহ হাতে পেতে অপেক্ষা করছে।
পরিস্থিতি সামাল দিতে ট্রেন এবং সামরিক বিমানে করে দেশের বিভিন্ন অংশ, এমনকি সিঙ্গাপুর থেকেও দিল্লিতে অক্সিজেন পরিবহনের ঘোষণা দিয়েছে ভারত সরকার। একই সঙ্গে গতকাল রাজ্য সরকারগুলোকে কেন্দ্র সরকারের সহায়তা নিয়ে প্রয়োজনে বেসরকারি খাতের মাধ্যমে ফিল্ড হাসপাতাল স্থাপনের আহ্বান জানানো হয়েছে।