হ্যাঁ, ঠিক এই প্রশ্নটিই আমি করেছিলাম আমা’র পরিচিত-অ’পরিচিত অসংখ্য মানুষকে। আমাদের সমাজের অ’ত্যন্ত প্রচলিত একটি ধারণা হচ্ছে- “ডিভোর্সের পর মে’য়েরা একা থাকতে পারে না!” শুধু ধারণা হয়, বলা যায় বদ্ধমুল ধারণা।এই একবিংশ শতাব্দীতে এসেও অসংখ্য মে’য়ে এই ধারণাটির কারণে সম্পূর্ণ জীবনটি কাটিয়ে দেন ক’ষ্ট আর হতাশায়।কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এই ধারণাটি কতটুকু সত্যি? বা এই ধারণাটা নিয়ে কী’ ভাবেন বর্তমানের নারী-পুরুষ?
যাদের কখনো ডিভোর্স হয়নি বা খুব কাছের কারো ডিভোর্স দেখা হয়নি… তাঁরা হয়তো কখনোই বুঝতে পারবেন না মূল অবস্থাটি। কিন্তু যারা গিয়েছেন বা এখনও যাচ্ছেন এই পরিস্থিতির মাঝ দিয়ে? হ্যাঁ, একমাত্র তারাই বলতে পারবেন যে সত্যিকারের পরিস্থিতিতি কেমন।আর তাই আমা’র প্রশ্নটি ছিল এমন কয়েকজন নারীর কাছে, যিনি ডিভোর্স পরবর্তী সময়টি মোকাবেলা করেছেন বা খুব কাছের কারো ডিভোর্স দেখেছেন।আমি জানতে চেয়েছিলাম এই ব্যাপারে তিনি কী’ মনে করেন, জানতে চেয়েছিলাম তাঁদের জীবনের ঝড়ঝাপটা গুলোর কথা। কী’ জবাব মিল? তাঁদের মন্তব্যগুলো নাহয় হুবহু-ই তুলে দিচ্ছি পাঠকের জন্য। বাকিটা পাঠক নিজ বিবেক দিয়ে বিবেচনা করবেন।
নাজিয়া মুশতারী (৩০) আমি থাকি আম্মুর সাথে.. সেরকমভাবে কোন সমস্যায় পড়িনি, বিকজ অফ আমা’র ভ’য়াবহ অ্যারোগেন্ট ইমেজের জন্য। এবং এটা আমি নিজেই বানিয়েছি। আমা’র ডিভোর্স হয়ে গেছে আমি অচ্ছুত হয়ে গেছি, আমা’র কেউ নাই- এরকম লুতুপুতু ইমেজ বানালে যে কেউ বির’ক্ত করতে আসবে।আর সবচে মজার বিষয় হচ্ছে আমা’র ব্যাপারটা থা’না পু’লিশ জে’ল অব্দি গড়িয়েছিল, কিছুটা হলেও শা’স্তি দিতে পেরেছিলাম, তাই সবাই এই ভ’য়টাও পায় কী’ভাবে লাল দালানে চালান দিতে হয় সেটা আমি জানি, তাই আমাকে না ঘাটানোই ভাল।আর একা থাকার আরেকটা বিষয় নিয়ে সমস্যা হয় সেটা হলো বাসাভাড়া কেউ দিতে চায়না, আবার বাচ্চার স্কুলে অন্য মহিলাদের অযথা কৌতুহল এবং সব সময় নিজেকে একটু সাবধানে রাখতে হয় যাতে কেউ গুজব রটাতে না পারে। তবে এগুলাও মেন্টেন করা যায়।
আম’রা কেউ ছোট বাচ্চা তো না যে নিজের অ’সুবিধা বুঝবোনা। একা থাকার সবচে বড় শর্ত হচ্ছে স্বাবলম্বী হওয়া, স্বাবলম্বী যে কেউ একা থাকতে পারে। কারো অনুগ্রহে বা অধীনে বাঁচতে গেলেই একা থাকা’টা আর হয়ে ওঠেনা।
সাবরিনা খান (৩৪), ব্যাংকার আমি ঠিক একা না। মা সাথে থাকে। দোকা থাকা অবস্থাই মা আমা’র সাথে থাকতো। তবে মা আমাকে আবার বিয়ে করতে আগ্রহী নই বলে ফ্ল্যাট কিনতে বলে। সে সহ সবাই ভ’য় দেখায় মা চিরজীবন থাকবে না, তখন আমা’র থাকার জায়গা থাকবেনা। আমি ভাবছি শুধু থাকার জায়গার জন্য কি বিয়ে করা লাগবে!
শাফিয়া (২৮), গৃহিণী সমাজের মানুষ তো একা থাকলেও বলবে, দোকা থাকলেও বলবে। একা বা দোকা থাকা সম্পূর্ণ নিজস্ব ব্যাপার হওয়া উচিৎ। তবে সমাজের কথাটা একেবারেই ফেলে দেওয়ার মতো ও নয়। কারণ-
১. প্রতিটা মানুষেরই একজন সংগী লাগে। যে সুখে দু:খে পাশে থাকবে।মানছি মে’য়েরা অনেক স্ট্রং, তারপরও, লাগে কিন্তু একজনকে। শারীরিক মানসিক চাহিদা পূরণের জন্য। অনেকেই হয়তো শারীরিক চাহিদা উপেক্ষা করে থাকতে পারে (রেশিওটা অনেক কম কারণ শারীরিক স’ম্পর্ক একবার হলে সেটাকে অগ্রাহ্য করাটা টাফ), অনেকে না পারায় অ’নৈতিক স’ম্পর্কে লিপ্ত হয়।আবার কেউ হয়তো মানসিক সাপোর্ট এর জন্যও একা থাকতে চায় না।
২. এই সমাজের মানুষই একা থাকতে দিবে না। একা মে’য়ে সাবলেটে থাকলেও খা’রাপ, একা থাকে। আবার চাকরি খুঁজতে গেলেও আগে বিছানায় যাওয়ার প্রস্তাব পায়…. তো বেশিরভাগ মানুষইযেহেতু সুযোগ সন্ধানী তারা তো এভাবেই দেখবে যে একা মানেই একা না, নিশ্চয়ই তার অ’বৈধ স’ম্পর্ক আছে। এই বাঁকা চোখটা এড়িয়ে ফাইট করতে ফ্যামিলি সাপোর্ট লাগে যেটা অনেকেই পায়না।৩. বেশিরভাগ পরিবারের কাছেই এখনো ডিভোর্সি মে’য়ে মানেই বোঝা। তাকে যে কোন ধরনের সাপোর্ট দিতে তারা নারাজ।
বাট আমা’র নিজের যা মনে হয়েছিলো এবার তাই বলি। প্রতিটা মে’য়েই নিজের একটা সংসারের স্বপ্ন দেখে। খুবই স্ট্রং একটা কারণে আমা’র প্রথম বিয়েটা টেকেনি। ৭ বছর চেষ্টা করেছি টেকানোর জন্য। বাট যেটা হওয়ার নয় সেটা হয়না।প্রথমে ভেবেছিলাম স্বাবলম্বী হই। বাট যেখানেই জবের জন্য যেতাম, আকারে ইংগিতে আমাকে বিছানায় শোয়ার আভাস দিতো। নিজের প্রতিই একসময় ঘেন্না লাগা শুরু হলো, যে আমা’রই নিশ্চয় কিছু একটা প্রবলেম, নাহলে সবাই এই নজরেই কেন দেখবে।তাই একা থাকার চিন্তা বাদ দিয়ে নতুন করে সংসার নিয়ে ভাবতে শুরু করেছিলাম কারণ বিয়ে ভাংগাতে তো আমা’র দোষ ছিলো না। স্বাভাবিক একটা জীবন চেয়েছিলাম। কারণ তখন হয়তো বয়স কম ছিলো। বাট একটা সময় বয়স বাড়বে।
শেয়ারিং কেয়ারিং এর জন্য হলেও জীবনে কাউকে প্রয়োজন। ছোট ছোট স্বপ্ন পূরণের স্বাদ শেয়ার করার জন্য হলেও কাউকে প্রয়োজন। আর আমাদের ধ’র্মেও কোথাও লেখা নেই যে ডিভোর্স হলে আর বিয়ে শাদি করা যাবে না। বরং সংসারের তাগিদই দেয়া আছে। ব্যক্তির সর্ব প্রকার শান্তির জন্যই আমা’র মনে হয় একা থাকা’টা ঠিক নয়। তবে সবারই এমনটা মনে হবে তা নয়, কারো সাপোর্ট পাইনি তাই হয়তো এমন মনে হয়েছে, ফ্যামিলি সাপোর্ট পেলে হয়তো অন্যরকম ভাবতাম। আসলে যার যার ভাবনা তার তার কাছে যেটা ডিপেন্ড করে সিচুয়েশন এর উপর।
নাজমুন নাহার (২৮), ব্রাক্ষনবাড়ীয়া নিজের সমস্যাটাই বলি, সাত বছর সংসার করার পর হ্যাজবেন্ডের সাইকোলজিক্যাল প্রবলেম এবং পারিবারিক কুটনীতির চালে ডিভোর্স হয়ে যায়।দুবছর একা আছি, প্রাইভেট হসপিটালে জব করি। সমাজ পারিবারিক অবস্থানের কারণে একা থাকা সম্ভবনা পারিবারিক সাপোর্ট কখনোই পাইনি।বরং পরিবার এবং আশপাশ থেকে শুনতে হয় মা-বাবা চিরদিন থাকে না, আবার নতুন করে চিন্তা কর, ভাইবোনরা সবসময় দেখবে না, তাছাড়া সমাজ কি বলবে? আমা’র প্রশ্ন কেন? সমাজ কি আলাদা কিছু, সমাজ তো আম’রাই তৈরী করি।
ভাইদের সংসার হবে, বোনের বিয়ে হবে, ঘরে ডিভোর্সী বোন থাকলে সমস্যা- এই ধারণা সমাজে পরিবারে কি আম’রা ছড়িয়ে দিচ্ছিনা? হ্যাঁ, দিনশেষে নিজেকে একা লাগে মনে হয় পাশে কাউকে দরকার এই দরকারটা কি শুধু সামাজিক পরিচিতির জন্য নাকি নিজের ভাল থাকার জন্য?সমাজের জন্য রিলেটিভদের জন্য তো সাত বছর নিজেকে সুখী কাপল সাজিয়েছি তাতে নিজে কতটুকু হ্যাপি হয়েছি… দুষ্টু গরুর চেয়ে শূন্য গোয়াল অনেক ভালো।প্রাচুর্য না থাকুক আত্মতৃপ্তি মানসিক শান্তি তো মেলে। আতংকিত জীবন থেকে মুক্তি। হ্যাঁ, এটা সত্যি পারিপার্শ্বিক সব অবস্থা চিন্তা করে একা থাকা’টা এই সমাজে নিরাপদ না। ধন্যবাদ আপু।
রোদসী জামান, টাঙ্গাইল ডিভোর্সী মে’য়েদের আমাদের সমাজ ভাল চোখে দেখে না, আপু। এমনকি আত্নীয় সজন ও প্রতিবেশীদের কথা জীবন অ’তিষ্ট করে দেয়।প্রায় আড়াই বছর হল ডিভোর্সের এখনও শুনতে হয় আর একটু সহ্য করে গেলেই নাকি পারতাম।কিন্তু আমি জানি ওটা আমা’র জীবনের সব থেকে ভাল সিদ্ধান্ত ছিল।আর একা থাকা না থাকা যার যার ব্যক্তিগত বিষয়।তুমি যদি মুভ অন করতে রেডি থাকো আর এমন কাউকে খুঁজে পাও যে তোমাকে বুঝে,তোমাকে সন্মান করে তাহলে কেন তার সাথে থাকবে না?
ফারিয়া রিশতা (২৫), ঢাকা ডিভোর্সের পর প্রথম যেটা ফিল করতাম সেটা হল শূন্যতা, মনের মধ্যে বিশ্বা’স ভঙ্গের হাহাকার। এমন এক সিচুয়েশনে ডিভোর্স হল, অফিসের কাজে ঢাকায় থাকা লাগবে, একা! ছোট ভাইটা সাথে থাকত কিন্তু ও বেচারা নতুন ভা’র্সিটি লাইফ আর এই ডিভোর্স এর মা’রপ্যাঁচ বোঝার ক্ষমতাও তার নাই। ডিভোর্সটা সম্পূর্ন আমা’র ডিসিশন ছিল, বাবা-মা সাপোর্ট এ ছিলেন।তারপর থেকে দিব্যিই একা একাই আছি। ইভেন গত কয়েকমাস সম্পূর্ণ একাই থাকছি। এক দিক দিয়ে ভাল হয়েছে সবার চেয়ে দূরে থেকে নিজেকে একটু গুছিয়ে নিতে পেরেছি। কিন্তু চেনাজানা জায়গাগুলাতে যেতে খুব আনইজি লাগে।
স্পেশালি অ’তি উতসাহী আত্বীয় স্বজনদের বাসায় যেতে আতংক লাগে। মনবল ভেঙে দেওয়ার জন্য তারাই যথেষ্ট। এইবার হল মেইন পার্ট যেটা লিখব বলে এত কিছু লেখা – ফেসবুক ইনবক্স বা মোবাইল মেসেজেস।কিছু পুরুষের আসল রূপ দেখা হয়ে গেছে ডিভোর্সি হওয়ার সুবাদে। তাঁদের ভাষ্যমতে ডিভোর্সি মে’য়েদের একা থাকতে শারীরিক ভাবে খুব ক’ষ্ট হয় আর তাদেরকে সাপোর্ট দেওয়া ইনাদের দ্বায়িত্ব বলে মনে করেন। আর সেই মানুষগুলা চেনাজানা মানুষগুলাই বেশি!
আপু, একা থাকা কঠিন কিছু না। আমা’র পুরা ডিভোর্সের ল’ড়াই একা আমি কোর্টে গিয়ে ল’ড়েছি যখন আমা’র বয়স মাত্র ২৪ ছিল। একা চাকরি করেছি, একা একটা বাসা নিয়ে থেকেছি। কিন্তু আমা’র মতে তার জন্য যথেষ্ট শক্ত হতে হবে।প্রথমে আমিও ২ বার সুই’সাইড করতে গেসিলাম। বাবা মা, কাছের বন্ধুদের সাপোর্ট ছিল বলে সারভাইভ করতে পেরেছি। এখন তো আরো ভাল আছি আলহাম’দুলিল্লাহ্। কিন্তু হ্যাঁ, মনে মনে নিজের একটা গুছানো সংসারের স্বপ্ন সেই কৈশোর কাল থেকেই দেখে এসেছি, এখনো দেখি । তবে এবার সেটা এমন একজন মানুষ এর সাথে যে আমাকে ভালবাসবে।
মোহসিনা খান (৩৩), উত্তরা আমি তো একা নই, পুরো ফ্যামিলির সাথে থাকি আপু.. মা সবচেয়ে বেশী সাপোর্ট দেয় বলে দরকার নাই বিয়ে করার .. নিজেকে প্রতিস্ঠিত কর জীবনে এ পুরুষ দরকার নাই.. আমা’র ছোট ভাই আমা’রে সারাজীবন আগলে রাখতসে এমন করে যেন আমি তার ছোট্ট বোন.. আমা’র ঐ কূৎসিত জীবনের চাইতে এই জীবন আমা’র অনেক সুখের আনন্দের ..আমি ভাল আছি।
নাজিয়া ইস’লাম (২৬)আমি ব্রোকেন ফ্যামিলির মে’য়ে,অনেক স্ট্রাগল করে এ পর্যন্ত আশা..আমা’র মা ডিভোর্সড না হওয়া সত্ত্বেও সেপারেশনে থেকেছেন।আমা’র নানুবাড়ীতে থেকে আমাকে সিংগেল মাদারের মতন করে বড় করেছেন..আমা’র ২বছর ৯ মাস বয়স থেকে..তবে এখানে সেপারেশনের ডিসিশনে যাওয়ার আগে অবশ্যই অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতার ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন,কারণ যে যাই বলুক টাকা ছাড়া জীবনযাপন আসলেই অসম্ভব। আর হ্যাঁ, বিবাহিত হয়েও পর্যাপ্ত অর্থের সংস্থান করতে পারছি না বলে কিছু কিছু ক্ষেত্রে এখনো বাবা,মামা এবং স্বামীর খোটা শুনতে হচ্ছে বৈকি…
মা আমা’র সাথেই থাকেন।তার ছে’লে সন্তান নেই..বাবার আলাদা পরিবার রয়েছে।এই বৈরী জীবনে মা কখনওই নিজের কথা ভেবে বাবার মতন সুখ খুঁজে নেন নি তাই আমিও পারবো না মে’য়ে বলে মায়ের প্রতি নিজের দায়িত্ব টুকুন এড়াতে !তবুও প্রয়োজনে জীবনের বাকী’টা পথ একা থাকতে হলেও রাজী,কিন্তু মাকে ছেড়ে চাকুরী ছেড়ে স্বামীর সংসারের রাজরানী হতে চাই না। আশা রাখি একদিন অবশ্যই মায়ের মুখে হাসি ফোটাতে পারবোই ইনশাআল্লাহ।সমঝোতা তো থাকেই তবে জীবনের এই স্টেজে এসে কিছু কিছু সিধান্ত হয়তো সহ’জেই নিতে পারতাম যদি পূর্ন অর্থনৈতিক স্বাবলম্বীতা থাকতো… আমা’র জীবনে মাকে কোন কিছুর বিনিময়েই আমি কম্প্রোমাইজ করতে পারবো না..তাতে যদি হতে হয় ডিভোর্সি.. না হয় তাই হলাম।তবুও এই ছোট্ট একটা জীবন ঠিকই কে’টে যাবে মা পাশে থাকলে,তবু নিজের আত্ম ম’র্যাদার সাথে আপোষ কখনওই নয়।