ফেসবুক, ইউটিউবসহ নেট দুনিয়ায় ইসলাম প্রচার করার মাধ্যমেই ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন আবু ত্ব-হা আদনান। এই ইসলামিক বক্তা হঠাৎই গত ১০ জুন থেকে নিখোঁজ হয়ে যান। নিখোঁজ হওয়ার সময় তার সঙ্গে গাড়িচালকসহ আরও তিনজন সহকর্মী ছিলেন। পাঁচদিন পার হয়ে গেলেও তাদের এখনো কোনো হদিস মিলছে না।
তরুণ এই ইসলামি বক্তার নিখোঁজ হওয়ার পরপরই তোড়পাড় শুরু সোশ্যাল মিডিয়া। তার সন্ধান চেয়ে হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করছে তার ভক্ত সমর্থকরা। তবে কে এই তরুণ ইসলামিক বক্তা আবু ত্বহা মুহাম্মদ আদনান?
তার নাম, মো. আফছানুল আদনান কিন্তু সবার কাছে তিনি আবু ত্ব-হা মুহাম্মদ আদনান নামেই সবার কাছে পরিচিত। ৩১ বছর বয়সী এই তরুণ বক্তার বাড়ি রাজশাহী হলেও তিনি রংপুর জেলায় নানা বাড়িতে বড় হয়েছেন। ২০১৮ সালে আলোকিত জ্ঞানী প্রতিযোগিতায় প্রথম রানার আর্প হয়েছিলেন তিনি।
নিখোঁজ ইসলামি বক্তা ত্ব-হা মুহাম্মদ আদনান রংপুর নগরীর সেন্ট্রাল রোডের আহলে হাদিস মসজিদ এলাকার বাসিন্দা। তবে তিনি প্রথম স্ত্রী হাবিবা নূর, দেড় মাসের ছেলে ও তিন বছরের মেয়েকে নিয়ে শালবন মিস্ত্রীপাড়া চেয়ারম্যান গলিতে ভাড়া বাসায় থাকেন।
আর ত্ব-হার দ্বিতীয় স্ত্রী সাবিকুন নাহার সারা। তিনি ঢাকার মিরপুর আল ইদফান ইসলামি গার্লস মাদ্রাসার পরিচালক ও শিক্ষক। তিন মাস আগে তাদের বিয়ে হয়েছিল। নিখোঁজ ইসলামী বক্তা আবু ত্ব-হা মুহাম্মদ আদনানকে ফিরে পেতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে আকুল আবেদন জানিয়েছেন ত্ব-হার দ্বিতীয় স্ত্রী সাবিকুন্নাহার।
ত্ব-হা আদনান নগরীর সুরভী উদ্যানের বিপরীতে প্রজন্ম নামে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। সেটির প্রধান সে। সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি কুরআন শিক্ষা দেয়া হতো ওই স্কুলে। করোনার কারণে স্কুলটি দেড় বছর ধরে বন্ধ।
এই ইসলামি বক্তা রংপুরের বিদ্যাপীঠ খ্যাত কারমাইকেল কলেজ থেকে দর্শন বিভাগ থেকে অনার্স, মার্স্টাস শেষ করেছেন। পাশাপাশি রংপুরের জামিয়া সালাফিয়া মাদ্রাসার ১০-১২ জন ওস্তাদের কাছ থেকে অ্যারোবিক গ্রামারসহ দ্বীনি বিষয়ে তালিম নিয়েছেন। তার পরে নিজেই ইসলামিক বইগুলো খুটিয়ে পড়ে জ্ঞান অর্জন করেছেন।
আবু ত্বহা মুহাম্মদ আদনান উঠতি একজন ইসলামি আলোচক, যিনি সুস্পষ্ট কথা বলার ভংগিমার কারণে তরুণদের মধ্যে দ্রুতগতিতে জনপ্রিয় হন। তার ধর্মীয় আলোচনার পক্ষে-বিপক্ষে আলাচনা এবং সমালোচনা দুটোই হতো।
আবু ত্ব-হা মুহাম্মদ আদনান রংপুর লায়ন্স স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এসএসসি, রংপুর সরকারি কলেজ থেকে বিজ্ঞান বিভাগে এইচএসসি পাস করেন। দর্শন বিষয়ে অনার্স মাস্টার্স পড়েন রংপুর কারমাইকেল কলেজে। ছাত্রজীবন থেকেই তিনি আহলে হাদিস সংগঠনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। ইসলামী বই প্রচুর পড়তেন। নিজের ফেসবুক পেজ ও ইউটিউবে ধর্মীয় আলোচনা করতেন। বিভিন্ন মসজিদে নামাজও পড়াতেন তিনি।
রংপুর সদরের বাসিন্দা তোহা নিজেকে ইসলামি স্কলার দাবি করেন। পড়াশোনা শেষ না হলেও তিনি ইসলাম ধর্মীয় বিভিন্ন স্পর্শকাতর বিষয়ে নিজের মতো করে ব্যাখা দিয়ে যাচ্ছেন অনেকদিন ধরেই, যা নিয়ে বিতর্কও আছে। সম্প্রতি ইউটিউবে প্রকাশিত তার বক্তব্যে ঢাকা শহরকে ‘কেয়ামতের শহর’ হিসাবে উল্লেখ করেন।
নারীর ক্ষমতায়নের বিরুদ্ধেও কথা বলেছেন তিনি। দাবি করেছেন, ‘যে নারী পুরুষের সঙ্গে পাবলিক বাসে উঠে অফিসে যায়, যে নারী সহকর্মী পুরুষের সঙ্গে কথা বলেন তারা দাজ্জালের বাহিনীর সদস্য। ইমাম মাহাদীর বিরুদ্ধে এই নারীরাই যুদ্ধ করবে।’
ইসলাম ধর্মমতে দুনিয়া ধ্বংস তথা কিয়ামতের আগে মুসলিমদের সঙ্গে দাজ্জালের বাহিনীর লড়াই হবে। আর মুসলিমদের নেতৃত্ব দেবেন ইমাম মাহাদী। ইমাম মাহাদী পৃথিবীতে কবে আসবেন, এ নিয়ে অবশ্য ইসলামিক বক্তাদের মধ্যে বিরোধ আছে। কেউ কেউ নিজেকে ইমাম মাহাদী পরিচয়ও দিয়েছেন নানা সময়।
ত্ব-হার দাবি, পরকালে দোজখে নারীদের সংখ্যা বেশি হবে। আর এর জন্য তার ভাষায় ‘নারীর উদ্ধত’ আচরণ দায়ী। প্রচলিত সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার বিরুদ্ধেও তোহা নানা সময় উসকানি দেয়ার চেষ্টা করেছেন বলে অভিযোগ আছে।
এদিকে পুলিশের কাছে তথ্য রয়েছে, আদনান আহলে হাদিস মতাদর্শের অনুসারী, তার নিজস্ব ইউটিউব চ্যানেলে ও অনলাইনে ইসলাম ধর্ম নিয়ে নানা বিষয়ে বক্তব্য দিতেন। যা নিয়ে নানা বিতর্ক ছিল। তার প্রতিপক্ষ ইসলামিক মতাদর্শের অনুসারীরা এ সব বিষয় ভাল ভাবে মেনে নিতেন না। এমনকি তার দেয়া বক্তব্য (ফেসবুক ও ইউটিউব) বিশ্লেষণ করছে পুলিশ।
উল্লেখ্য, গত বৃহস্পতিবার (১০ জুন) বিকাল ৪টার দিকে তিন সঙ্গীসহ আদনান রংপুর থেকে ভাড়া করা একটি গাড়িতে ঢাকায় রওনা দেন। তারপর তারা নিখোঁজ হন। নিখোঁজের সময় ত্ব-হার সঙ্গে আব্দুল মুহিত, মোহাম্মদ ফিরোজ ও গাড়িচালক আমির উদ্দিন ফয়েজ ছিলেন। তারাও নিখোঁজ রয়েছেন।
ওই রাত থেকে সবার মোবাইল ফোনই বন্ধ রয়েছে। এ ঘটনায় শুক্রবার বিকালে রংপুর মহানগরীর কোতোয়ালি থানায় ত্ব-হার খোঁজ চেয়ে থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছেন তার মা আজেদা বেগম।
পুলিশের একটি সূত্র জানায়, আবু ত্ব-হা মুহাম্মদ আদনান বৃহস্পতিবার রাত ২টা ৩৭ মিনিটে রাজধানীর গাবতলী থেকে সর্বশেষ যোগাযোগ করেন তার দ্বিতীয় স্ত্রী সাবিকুন নাহার সারার সঙ্গে। সে সময় দুই ব্যক্তি তাকে অনুসরণ করছে বলে ত্ব-হা তার দ্বিতীয় স্ত্রীকে জানিয়েছিলেন।
গুগল ম্যাপে দেখা গেছে, ত্ব-হার দ্বিতীয় স্ত্রীর বাসা থেকে তার গাড়ির দূরত্ব ছিল ৬ দশমিক ৪ কিলোমিটার দূরে। সেখানে পৌঁছাতে সময় লাগতো ১৮ মিনিট। এর কিছুক্ষণ পর থেকেই তার ফোন বন্ধ, তিনি নিঁখোজ।
ত্ব-হার দ্বিতীয় স্ত্রী সাবিকুন নাহার সারা মিরপুর আল ইদফান ইসলামী গার্লস মাদ্রাসার পরিচালক ও শিক্ষক। তিন মাস আগে তাদের বিয়ে হয়েছিল। আর প্রথম স্ত্রী আবিদা নুরকে নিয়ে তিনি রংপুরের শালবনের চেয়ারম্যানের গলিতে ভাড়া বাসায় থাকতেন ত্ব-হা।
এ ব্যাপারে রংপুর মহানগর পুলিশের উপ-পুলিশ কমিশনার (অপরাধ) আবু মারুফ হোসেন বলেন, ‘সব ধরনের কারণ ও সন্দেহ মাথায় রেখে তদন্ত কাজ চলছে। তবে এখনই স্পেসিফিক কিছু বলা যাচ্ছে না’।