তখন বিকাল সাড়ে ৫টার বেশি। সেজান জুস কারাখানার নিচতলায় দাউদাউ করে আগুন জ্বলছিল। তখনো উপরের তলার ফ্লোরে কর্মরত অনেকেই বুঝে উঠতে পারেননি কী এক ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি অপেক্ষা করছিল তাদের ভাগ্যে।
কিছু বুঝে উঠার আগেই সর্বগ্রাসী আগুন ছড়িয়ে পড়েছিল উপরের ৫টি ফ্লোরেই। আগুনের তাপ আর ধোঁয়ায় নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসা শ্রমিকরা বাঁচার জন্য ছুটছিলেন দিগ্বিদিক। নিচতলায় আগুন লাগায় উপরের তলার কেউই সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে পারছিলেন না। ফলে জীবন বাঁচাতে লাফিয়ে পড়ছিলেন কোনো কিছু না বুঝেই। তৃতীয় তলা থেকে লাফিয়ে পড়ে মৃত্যু হয়েছে ৩ জনের।
এমন একটি ভিডিও এসেছে যুগান্তরের হাতে, যা দেখলে মনে হবে কোনো বিদেশি ছবির শুটিং চলছে। কিন্তু না, এটাই ছিল রূপগঞ্জের সেজান জুস কারাখানার সেই মৃত্যুপুরীর প্রকৃত চিত্র। প্রাণ বাঁচাতে অনেকটা কাঠের পুতুলের মতো উপর থেকে একের পর এক লাফিয়ে পড়ছেন শ্রমিকরা। আর আটকে পড়াদের গগনবিদারী চিৎকার যেন জানান দিচ্ছিল এক চরম অসহায়ত্বের।
সেই মৃত্যুপুরী থেকে বেঁচে এসেছে শ্রমিক ফাতেমা (১৫)। তৃতীয় তলায় কাজ করছিল ফাতেমা আর তার সহকর্মী। আগুনে ঝলসে মৃত্যুর চেয়ে নিচে লাফিয়ে পড়াও যেন শ্রেয় ছিল সেই সময়। শুধু ফাতেমাই নয়, ওর মতো শত শত শ্রমিক তখন লাফিয়ে পড়ে নিচে। অনেকে বাঁচার আশায় ৬ তলার ছাদ থেকেও লাফিয়ে পড়ে পাশের টিনশেডের উপর, কেউবা সরাসরি নিচে। মৃত্যুপুরী থেকে বেঁচে আসা ফাতেমা এখনো সেই ভয়ঙ্কর স্মৃতি মনে করে আঁতকে উঠে।
অসুস্থ বিধ্বস্ত কিশোরী ফাতেমা জানায়, আমি ও আমার সঙ্গে একজন তৃতীয় তলায় বোতল ছিদ্র করার কাজ করছিলাম। তখনো জানি না যে আগুন লেগেছে। হঠাৎ আমার সঙ্গে থাকা একজন পেছনে দেখে ধোঁয়া আর আগুন। আমরা তখন ছোটাছুটি করতে থাকি। মুহূর্তেই আমরা ধোঁয়ার কারণে নি:শ্বাস নিতে পারছিলাম না, দম বন্ধ হয়ে আসছিল।
প্রথম তলায় আগুন লাগায় নিচেও নামতে পারছিলাম না। আমাদের নামার জন্য রশি বা মই কিছুই দেয়া হয়নি। এ সময় দেখলাম বিল্ডিংয়ের সামনের বড় সাঁটার গেট দিয়ে অনেকেই লাফিয়ে নিচে পড়ছে। আমি ভাবলাম নিচে লাফ দিয়ে মরি বাঁচি কিন্তু আগুনে মরার চেয়ে ভালো। জীবন বাঁচাতে তাই তৃতীয় তলা থেকে নিচে লাফ দিয়ে অজ্ঞান হয়ে যাই।
ফাতেমার এ সময় কথা বলতেও বেশ কষ্ট হচ্ছিল। লাফ দেয়ার কারণে তার পায়ে বেশ কিছু অংশ কেটে ও থেঁতলে গেছে। বুকে চোট লাগায় শ্বাস নিতেও কষ্ট হয় তার। চিৎকার করায় গলাও ব্যথা।
ফাতেমা জানায়, একটি ছেলে তার মাথায় পানি ঢেলে জ্ঞান ফেরানোর পর সে তার মামাতো বোনের খোঁজ করতে থাকে। সে তখন ৪র্থ তলার সেই মৃত্যুপুরীতে আটকা ছিল।
ফাতেমা দাবি করে, ৪ তলা থেকে নামার কলাপসিবল গেটটি তখন তালাবদ্ধ ছিল। মালিকের নির্দেশে ওই ফ্লোরের গেটে তালা লাগিয়ে রাখা হয়।
এ সময় কারখানার কর্মকর্তারা তাদের জানায়, ৪র্থ তলার এসি রুমে ‘ওরা’ নিরাপদ আছে, ওখানে কিছু হবে না। কিন্তু পুরো ফ্লোরেই তখন আগুনের লেলিহান শিখায় পুড়ে ছাই করে দিয়েছে সব। সেখানে থাকা কোনো শ্রমিক আর বাঁচতে পারেনি।
উল্লেখ্য, ৪র্থ তলার যে ফ্লোর থেকে ৪৯টি মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছিল তাদের সবাই একটি স্থানেই জড়ো হয়েছিল বলে জানিয়েছিলেন উদ্ধারকারীরা। ধারণা করা হচ্ছে ফাতেমার এ বক্তব্যই ছিল সেই ৪৯ হতভাগ্যের নিয়তি।
এদিকে ফাতেমা দাবি করে, ছাদ থেকে ও বিভিন্ন ফ্লোর থেকে নিচে লাফিয়ে পড়া অনেকেই মারা গেছেন।
সে জানায়, বলা হয়েছিল প্রথমে ২ জন লাফ দিয়ে মারা গেছে। কিন্তু আমার চোখের সামনে অনেকেই লাফ দিয়ে মারা গেছে। ছাদ থেকে যারা লাফ দিয়েছে তাদের বেঁচে থাকার কথা না।
অপরদিকে যুগান্তরের হাতে আসা ভিডিওটিতে দেখা যাচ্ছে, আগুন লাগার পর কারখানার একটি ফর্কলিফ্ট (মালামাল তোলার ছোট গাড়ি) দিয়ে শ্রমিকদের বাঁচানোর চেষ্টা করা হচ্ছিল। মালামাল উপরে উঠানো কিংবা সারিবদ্ধ করে রাখার ওই গাড়ীতে একত্রে উঠে পড়ছিলেন অনেক শ্রমিক। কেউ কেউ সেটিতে উঠার সুযোগের অপেক্ষায় না থেকে লাফিয়ে পড়ছিলেন ৩য় ও ২য় তলা থেকে। একপর্যায়ে উপর থেকে লাফিয়ে পড়া শ্রমিকরা সেই গাড়ির লিফ্টের উপরই আছড়ে পড়েন। শনিবার সরেজমিন কারখানায় গিয়ে দেখা যায় সেই গাড়িটি।