বাবা মা’দের স্বপ্ন থাকে যখন তার সন্তানকে একদিন দেশের সবচেয়ে ভালো প্রতিষ্ঠানে পড়াবে, তখন প্রথমেই যে নামটি মাথায় আসে সেটা বুয়েট কিংবা মেডিকেল। বুয়েট যে দেশের কোটি শিক্ষার্থীর স্বপ্নের স্থান, তা দেশের সব ছেলে মেয়েই জানে। কিন্তু সম্প্রতি কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা যেন দেশের খ্যাতমান এই বিদ্যাপীঠটির চরিত্রে দাগ ফেলেছে। যদিও প্রতিষ্ঠানে পড়ুয়া দুই একজনের জন্য বুয়েটের সম্মানহানি কেউ করতে পারে না, তবু এমন আচরণের পর হয়তো সেগুলো প্রভাব ফেলবে ভবিষ্যতে বুয়েটে পড়ার স্বপ্ন দেখা হাজার হাজার শিক্ষার্থী এবং তাদের অভিভাবকদের মনে।
আবরার হত্যার পর বুয়েটের চরিত্রে যেমন দাগ লেগেছিল, তেমনি সম্প্রতি এক ঘটনায় আবারও কথা উঠেছে বুয়েটে দেশের সবচেয়ে মেধাবান শিক্ষার্থীদের মেধা নিয়ে। এবার হত্যা কিংবা গুমের মতো ঘটনা ঘটেনি বটে, তবে যা ঘটেছে তা দেশের সবচেয়ে ‘মেধাবী’ মস্তিষ্ক থেকে এসেছে বলে মেনে নেয়া কঠিন। যখন দেশে মেয়েদের নিরাপত্তা নিয়ে চলা আন্দোলন হয়, তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বুয়েট সেই আন্দোলনের প্রথম সারিতে অবস্থান করে। বুয়েটের সেই শিক্ষার্থীরাই আজ যুক্ত হলো সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্টের মতো বড় অপরাধে! যেখানে ভুক্তভোগী বারবার সতর্ক করার পরেও থামেনি তাদের হ্যারাসমেন্ট। বরং সেটি থেমেছে নিকৃষ্টতার সর্বোচ্চ শিখরে।
তবে বুয়েটের সব শিক্ষার্থী-ই যে এমন বা এগুলোকে প্রশ্রয় দেয়, এমন ভাবার কোনো কারণ নেই। নিজেদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছোট বোন কিংবা বান্ধবীর সাথে ঘটে যাওয়া এই অপরাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে তারা। প্রত্যেক স্থানেই যে কীট থাকে, সেটি-ই যেন প্রমাণ করতে নিয়েছে ব্যবস্থা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট দিয়ে সেসব পাষণ্ডের মুখ উম্মোচন করেছে তারা।
বুয়েটের সিএসই ডিপার্টমেন্টে পড়ুয়া হাফিজুল হক চৌধুরী (Hafijul Hoque Chowdhury) নামের এক ফেসবুক একাউন্ট থেকে গতকাল শুক্রবার (২৩ জুলাই) একটি স্ট্যাটাস দেয়া হয়। যেটি সামনে আসার পরেই খুব দ্রুত ভাইরাল হয়ে যায়। তোলপাড় তৈরি হয় দেশের সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারীদের মাঝে। স্ট্যাটাসে হাফিজুল পুরো ঘটনা তুলে ধরেছেন। কিভাবে বুয়েটেরই এক শিক্ষার্থী আরেক শিক্ষার্থীকে সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্ট করেছে। সাড়া না পেয়ে কিভাবে ম্যাসেঞ্জার গ্রুপে পরিকল্পনা করে নিজের নগ্ন-অর্ধনগ্ন ছবি মেয়েটিকে পাঠিয়েছে। হাফিজুল তার স্ট্যাটাসে সবগুলো কথোপকথনের স্ক্রিনশট তুলে ধরেছে। বিডি২৪লাইভের পাঠকদের জন্য হাফিজুল হক চৌধুরী’র সেই স্ট্যাটাসটি হুবহু তুলে ধরা হলো। এছাড়া নিউজের সত্যতা যাচাইয়ে হাফিজুল হক চৌধুরী’র ফেসবুক স্ট্যাটাসের লিংকটি নিচে দেয়া হল।
হাফিজুল হক চৌধুরী’র সেই স্ট্যাটাস-
”অত্যন্ত লজ্জাজনক একটা ঘটনা জানাতে আজকের এই পোস্ট। এই লজ্জাজনক ঘটনার অভিযুক্তরা হলঃ
১। জারিফ হোসাইন, নটরডেম কলেজ, গ্রুপ-১২, বুয়েট সিএসই ১৯
২। সালমান সায়ীদ, নটরডেম কলেজ, গ্রুপ-১, বুয়েট সিএসই ১৯
৩। জারিফ ইকরাম, নটরডেম কলেজ, গ্রুপ-১, বুয়েট সিএসই ১৯
৪। জায়ীদ মানোয়ার চৌধুরি, সানিডেল স্কুল, ব্যাচ-১৯, বুয়েট সিএসই ১৯
ঘটনার বিবরণঃ ঘটনার শুরু ২০২০ সালের নভেম্বর মাসে। বন্ধুদের কাছে জারিফ হোসাইন (Zarif Hossain) বুয়েট ১৯ এর জনৈক মেয়ে “ক” কে পছন্দ করবার কথা উল্লেখ করে। এটা নিয়ে কিছু আলাপ আলোচনা হয়ে ঘটনা সেদিনকার মত শেষ হয়ে যায়।
এরপর ২৯ মে ২০২১ এ জারিফ হোসাইন বাকি ৩ জনের প্ররোচণায় “ক” কে প্রথম মেসেঞ্জারে মেসেজ দেয়। এরপরের প্রতিটি মেসেজেই তার দাম্ভিকতা প্রকাশ পায়। এরপরে সে নিজের সেলফি দেয়া শুরু করে। “ক” আগ্রহ না দেখানো সত্ত্বেও সে থামে না, এবং ৩ জুন, ২০২১ এ গিয়ে “ক” এর ইনবক্সে নিজের অর্ধনগ্ন ছবি এবং আপত্তিকর ইমোজি সেন্ড করে। এতে “ক” অত্যন্ত রাগান্বিত হয়ে জারিফ হোসাইনকে সরাসরি না করে। তখন জারিফ হোসাইন “ক” এর কাছে বারবার ক্ষমা চায় এবং মেয়েটি তখন ব্যাপারটা সেখানেই বাদ দিয়ে দেয়। এরপর দেড় মাস আর কোনো কথা হয় নি।
এরপর গত ২২ জুলাই ২০২১ সন্ধ্যায় এ অভিযুক্ত ৪ জন একটি রেস্টুরেন্টে দেখা করে “ক” এর ইনবক্সে জারিফ হোসাইন আবারো মেসেজ দেয়, এবং এবার অশ্লীল এবং আপত্তিকর ছবি দিতে থাকে, “ক” বারবার বারণ করা সত্ত্বেও। এক পর্যায়ে গিয়ে জারিফ হোসাইন তাকে অত্যন্ত কুরুচিপূর্ণ এবং অশ্লীল একটা ভিডিও সেন্ড করে। এরপরে “ক” পুরো ব্যাপারটা ১৯ এর মেয়েদের প্ল্যাটফর্মে শেয়ার করে।
সিএসই ১৯ এর সি আর এই ঘটনা জানামাত্র সিএসই ১৯ এর মেসেঞ্জার গ্রুপে প্রকাশ্যে জারিফ হোসাইন এর থেকে ব্যাখ্যা দাবি করে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ২২ তারিখ রাত ১০টায় পুরো সিএসই ১৯ এর সম্মিলিত মিটিং বসে। মিটিং এর শুরুতেই জারিফ হোসাইন মে মাসের ২৯ থেকে ৩ জুন পর্যন্ত সকল ঘটনার দায় স্বীকার করে।
উল্লেখ্য, তখনো বাকি ৩ জনের সম্পৃক্ততা উল্লেখই করা হয় নি। তবে জারিফ হোসাইন ২২ জুলাইয়ের ঘটনাটিকে একটি “হাস্যকর দুর্ঘটনা” হিসেবে চালিয়ে দেবার চেষ্টা করে এবং প্রায় ২ ঘণ্টা যাবৎ এই দাবির পক্ষে নাটক চালিয়ে যায়। শেষে অপারগ হয়ে সে সমস্ত দায় স্বীকার করে, এবং বাকি ৩ জনের নাম উল্লেখ করে। সে দাবি করে যে, বাকি ৩ জনও পুরো ঘটনার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সম্পৃক্ত ছিল। এই পর্যায়ে বাকি ৩ জনকে ডেকে এনে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে পরে তারা স্বীকার করে যে তারা “ক” কে মেসেজ দেবার ব্যাপারে জারিফ হোসাইনকে কুপরামর্শ দিয়েছিল, সম্মিলিত প্রয়াসে ছবি তুলে দিয়েছে, জারিফ ইকরামের বাসায় বসে ৩ জনের উপস্থিতিতে জারিফ হোসাইনের পূর্বে উল্লেখিত অশ্লীল ভিডিওটি রেকর্ড করা হয়েছে।
এরপর তারা নিজেদের পক্ষে অনেক রকম কারণ ও প্রমাণ দাঁড় করাবার চেষ্টা করে। তখন জারিফ হোসাইন ওদের ৪ জনের প্রাইভেট গ্রুপের মেসেজ মিটিং এ শেয়ার করে। তখন তারা “আমরা তো জাস্ট মজা করতেসিলাম”, “আমি এমনই”, “হার্মলেস প্র্যাংক”, “চাইল্ডিশ প্র্যাংক” এসব বলে। তারা কোনোভাবেই নিজেদের অপরাধ স্বীকার করে না, উলটো উদ্ধতভাবে নিজেদের ডিফেন্ড করার চেষ্টা করে। তারা দাবি করে যে তারা বুঝতে পারে নি যে মেয়েটা এভাবে রিয়্যাক্ট করবে।
এরপর ২৩ জুলাই পুরো সিএসই ডিপার্ট্মেন্টের ব্যাচ মিটিং অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে সকল ডকুমেন্ট সর্বসমক্ষে প্রকাশ করা হয়। তখন তারা আবারো নিজেদের উদ্ধতভাবে ডিফেন্ড করার চেষ্টা করে, একে অপরের উপর দায় চাপানোর চেষ্টা করে। কিন্তু সকল এভিডেন্স তাদের বিপক্ষে যায়।
তাই সর্বশেষে সিএসই ডিপার্ট্মেন্ট এর সকল শিক্ষার্থী জারিফ হোসাইন (Zarif Hossain), জারিফ ইকরাম (Zarif Ikram), সালমান সায়ীদ (Salman Sayeed), জায়ীদ মনোয়ার চৌধুরী (Jaid Monwar Chowdhury) কে অনির্দিষ্টকালের জন্য বয়কট করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সিএসই ১৯ তাদের সাথে সকল প্রকার সম্পর্ক ছিন্ন করেছে, এবং পুরো সিএসই ডিপার্টমেন্ট তাদেরকে সবরকম এক্সট্রা কারিকুলার অ্যাক্টিভিটি থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য বর্জন করছে। তাদের সকল কর্মকাণ্ডের বিবরণ যথাযথ কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। বুয়েট সিএসই ১৯ এর একজন শিক্ষার্থী হিসাবে আমিও তাদের বয়কট করছি।
আপনারা যারা এই অভিযুক্তদের চিনেন বা জানেন, আপনাদের প্রতি আমাদের আহবান, আমাদের সাথে একাত্নতা পোষণ করে তাদেরকে সামাজিকভাবে বয়কট করুন এবং তাদেরকে তাদের কৃতকর্মের ফল ভোগ করতে বাধ্য করুন। এই ঘটনায় ভুক্তভোগীর কাছে আমরা বুয়েট সিএসই ১৯ আন্তরিকভাবে লজ্জিত এবং ক্ষমাপ্রার্থী। তার পরবর্তী যেকোনো পদক্ষেপে আমরা সার্বিক সহযোগিতা করতে প্রস্তুত আছি।”