কঠোর বিধি-নিষেধ বা লকডাউন শেষ হওয়ার পাঁচ দিন আগে সরকারের সিদ্ধান্তে গতকাল রবিবার থেকে রপ্তানিমুখী শিল্প-কারখানা খুলে গেছে। এ ক্ষেত্রে সরকারের যে শর্ত ছিল, অর্থাৎ গ্রামে থাকা শ্রমিকদের এখনই ডেকে আনা যাবে না, সেটা ব্যবসায়ীদের অনেকে মানেননি। রীতিমতো খবর দিয়ে শ্রমিকদের কর্মস্থলে আনা হয়েছে। শনিবার সারা দিন কর্মস্থলমুখী জনস্রোত ও বিশৃঙ্খলা দেখে রাতে গণপরিবহনে ছাড় দেওয়া হয়। এ ঘটনা করোনা সংক্রমণ আরো বাড়বে বলে শঙ্কা করছে সংশ্লিষ্ট মহল। এ বিষয়ে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী জাহিদ মালেকের সঙ্গে কথা বলেছেন তৌফিক মারুফ।
যতবারই আমরা চাই সংক্রমণের লাগাম টানতে, বৈজ্ঞানিক পরামর্শমতো সংক্রমণের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিতে, কোনোবারই তা শেষ পর্যন্ত নিতে পারলাম না। ক্ষতি তো সবার হচ্ছেই। পূর্বনির্ধারিত মেয়াদ অনুসারে আর পাঁচটা দিন কেন ধৈর্য ধরা গেল না! সামনে পরিস্থিতি কী হবে তা নিয়ে খুবই শঙ্কিত। শুধু একটি সেক্টরের কারণে আমরা বারবার পিছিয়ে পড়ছি,
অন্য সব সেক্টর ধৈর্য ধরে সহ্য করলেও একটি সেক্টর যেভাবে লাখ লাখ শ্রমিককে অমানবিকভাবে টানাহেঁচড়া করে নানাভাবে ঝুঁকি-দুর্ভোগের মুখে ঠেলে দেয়, তাদের চলাচলপ্রক্রিয়ায় যুক্ত হয়ে পড়া লাখো মানুষের মধ্যে সংক্রমণের গতি ঊর্ধ্বমুখী করে তোলে, তার চেয়ে দুঃখজনক আর কী হতে পারে! তারা কেন বোঝে না করোনাভাইরাস শুধু স্বাস্থ্যের বিষয় নয়, সবার বিষয়। সমন্বিত মনোভাবে যার যার বিভাগের দায়িত্ব পালন না করলে এই মহামারি থেকে সুরক্ষা মিলবে না।
সংক্রমণের উৎস বন্ধ করতে যদি সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলো সহায়তা না করে তবে কী করে চলবে। কত দিন আমরা এভাবে চলতে পারব। স্বাস্থ্য খাতের জায়গা থেকে আমরা টিকা আনছি। মাঝে সমস্যা ছিল তা এখন কেটে গেছে, টিকায় গতি ফিরেছে। টিকা দিচ্ছি, হাসপাতালের সক্ষমতা যতটা সম্ভব বাড়িয়েছি, জনবলের ঘাটতি যতটুকু পারা যায় কাটানোর চেষ্টা করছি। কিন্তু কতটাই বা আর বাড়ানো যায়। যেভাবে রোগীর ঢল নামছে তাতে তো আমাদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে।
করোনায় মৃত্যু ও রোগী শনাক্ত সর্বোচ্চ পর্যায়ে রয়েছে। কিন্তু আমরা স্বাস্থ্যের লোকজন-চিকিৎসক-নার্সরা তো আর রাস্তায় নেমে মানুষের চলাফেরা ঠেকাতে পারি না। ব্যবসা-বাণিজ্যিক অঙ্গনকে নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব তো আমাদের না। আমরা গাইডলাইন দিয়েছি, সে অনুপাতে অন্য সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলো সহযোগিতামূলক কাজ করলেই সংক্রমণ কমে আসে। সেটার প্রমাণ তো কিছুটা হলেও পাওয়া যাচ্ছে। বিধি-নিষেধের কারণেই আক্রান্ত-মৃত্যুর ঊর্ধ্বগতি এখনো অনেক দেশের তুলনায় কমিয়ে রাখা যাচ্ছে।
কিন্তু একবারও যদি টানা ১৪ দিন পরিপূণ বা সফলভাবে বিধি-নিষেধের মেয়াদটা পার করা যেত, তবে কতটা সাফল্য পাওয়ায় যায় সেটাও অন্তত দেখা যেত। কিন্তু সেটাও পারলাম না। গার্মেন্ট সেক্টরের প্রতি আমাদের অনুরোধ ছিল, অন্তত ১৪টা দিন সময় দেন, দেখি না কতটা কমানো যায়; কিন্তু এবারও তা হলো না। এটাই বড় আক্ষেপ। এখন তো আবার বেড়ে যাবে। সামনে আক্রান্ত ও মৃত্যু কতটা বাড়বে তা নিয়ে খুবই শঙ্কার মধ্যে পড়ে গেছি।
রপ্তানির অজুহাত দেওয়া হয়। শুধু তো গার্মেন্ট সেক্টরই রপ্তানি করে না, আরো অনেক সেক্টরেরই অবদান আছে। দেশীয় শিল্প-কলকারখানা, ব্যবসা-বাণিজ্য সবই তো ক্ষতির মুখে আছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ মাঝে কিছুটা ভালো অবস্থায় গেলেও আবার সেখানে সংক্রমণ বাড়তে শুরু করেছে। আবার লকডাউন-কারফিউ দিচ্ছে।
নতুন নতুন নির্দেশনা দিচ্ছে। যেসব দেশে আগে তেমন কোনো সংক্রমণ হয়নি সেখানেও সংক্রমণ হচ্ছে। ফলে সার্বিকভাবেই বিষয়গুলো সবার বিবেচনায় রাখা দরকার। জীবিকা জরুরি—এটা কে না জানে। কিন্তু জীবন বাঁচলে তো জীবিকার প্রশ্ন। যারা মারা গেছে তাদের পরিবারগুলোর কী অবস্থা!
আমরা একদিকে রোগ কমাই, অন্যরা আবার রোগ ছড়িয়ে দিয়ে হাসপাতাল ভরে ফেলে, আর দোষ হয় আমাদের। রোগের উৎস যারা বন্ধ করতে পারে না তাদের যেন কোনো দোষই কেউ দেখে না!