সন্তান প্রসবের ক্ষেত্রে বহুল প্রচলিত একটা পদ্ধতি সিজার। মা যখন প্রসবকালীন সময়ে অসহনীয় ব্যথা সহ্য করতে না পেরে চিৎকার করে তখন সিজারের মাধ্যমে প্রসব করানো হয়। আবার অভিযোগ আছে, বাণিজ্যিক স্বার্থের কথা চিন্তা করে অনেক ডাক্তার স্বাভাবিক সন্তান প্রসব পদ্ধতি এড়িয়ে গিয়ে
মাকে বা মায়ের আাত্মীয় স্বজনকে সিজারের জন্য প্রলোভিত করে। এমন অভিযোগ সবসময় সত্য না হলেও কখনো কখনো অবশ্যই সত্য। তবে সিজার- এর কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া রয়েছে। রয়েছে নানা ক্ষতিকর দিক।
শুধু প্রসবকালীন সময়েই নয়, সিজারের মাধ্যমে সন্তান প্রসব করলে সারা জীবন একজন মাকে এসব পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় ভুগতে হয়। মায়ের স্বাস্থ্যের জন্যও সিজার ঝুঁকিপূর্ণ। তাই কী কী নিয়ম মেনে চললে সিজার এড়ানো সম্ভব একুশে টেলিভিশন অনলাইন পাঠকদের জন্য আমরা আজকে তা নিয়ে আলাপ করবো।
খুব বেশিদিন আগের কথা নয়, আমাদের মা- খালাদের সময়ের কথা চিন্তা করলে এখনকার সময়ে সিজারের হার অনেক বেশী। আমি বা আমাদের বয়সের যারা আছেন তাদের অনেকেরই ডেলিভারী হয়েছে ঘরে। বেশিরভাগ মায়েদেরই হয়েছে নরমাল ডেলিভারী। সিজার ডেলিভারীর পরিমাণ তখন খুব কম ছিল। আজকের সময়ে এসে সিজারের পরিমাণ হঠাৎ করে অনেক বেড়ে গেছে। এই তুলনা থেকে একটা বিষয় নিশ্চিত করে বলা যায়, আমাদের জীবনযাত্রায় এমন কোন পরিবর্তন নিশ্চয় এসেছে যার ফলে সিজার- এর পরিমাণ বাড়ছে। আসুন, আমরা এর কারণগুলো নির্ণয় করি।
প্রথমত, এখনকার মেয়েদের সহ্য ক্ষমতা একেবারেই কমে গেছে। তারা এখন নরমাল ডেলিভারীর কথা চিন্তা করতে পারেনা। তারা ব্যথাটা নেওয়ার কথা চিন্তা করতে পারেনা। আগে মেয়েদের মধ্যে একটা প্রেরণা ছিল যে, আমাকে ব্যাথাটা মেনে নিতে হবে। ঘরেই ডেলিভারী করাতে হবে। ফলে তারা সিজারমুখী হতো না। অর্থাৎ মানসিক একটা প্রস্তুতি ছিল। যেটা এখনকার অধিকাংশ মেয়েদের নেই। দ্বিতীয়ত, এখন অনেক সহজে হাসপাতাল, ডাক্তার ও যাবতীয় স্বাস্থ্যসেবা পাওয়া যায়। মাত্র তিনদিন হাসপাতাল থেকে সিজার রোগী বাসায় ফিরে যেতে পারছে। ফলে তারা এটাকে খুব ভয়ানক বা জটিল মনে করছে না।
তৃতীয়ত, ডাক্তার হিসেবে আমি বলব গর্ভধারণের শুরু থেকেই তার খাওয়া দাওয়া, চলা ফেরা এমন হতে হবে যাতে তার নরমাল ডেলিভারী নিশ্চিত করা সম্ভব হয়। যেমন: গর্ভাবস্থায় অতিরিক্ত শর্করা জাতীয় খাবার, অতিরিক্ত চিনি, অতিরিক্ত জাঙ্ক ফুড বা ফার্স্টফুড এগুলো না খাওয়া ভাল। এগুলোতে তার ওজন বাড়বে। ফলে সাত- আট মাসের সময় ডায়াবেটিস, প্রেসার এ জাতীয় সমস্যাগুলোর মুখোমুখি হবে।
চতুর্থত, সারাদিন শুয়ে বসে থাকার অভ্যাস যদি কারো থাকে তা প্রত্যাহার করতে হবে। অনেকে গর্ভধারন করার সাথে সাথে চাকরি, ব্যবসা, পড়াশুনা, কাজ কর্ম সব বাদ দিয়ে সারাদিন শুয়ে বসে থাকে। এর ফলে অসুখ বিসুখের প্রবণতা বাড়বে। তা না করে তিনি যদি সবসময় স্বাভাবিক কাজকর্মের ভেতরে থাকে তাহলে প্রসবকালীন সময়ে জটিলতা এড়িয়ে স্বাভাবিক প্রসব সম্ভব।
পঞ্চমত, নিয়ম মেনে চলার বিকল্প নেই। সকালে নির্দিষ্ট সময়ে সকালের নাস্তা করবে, নির্দিষ্ট সময়ে দুপুরের ও রাতের খাবার খাবে, প্রতিদিন রুটিন মেনে কমপক্ষে আধাঘন্টা হাঁটাহাঁটি করবে, রাতে ঘুমাবে- এভাবে যদি প্রথম থেকেই মেনে চলতে পারে তাহলে একটা স্বাভাবিক ও আদর্শ ওজন বজায় থাকে। শরীর ফিট থাকবে। এরফলে তিনি স্বাভাবিক প্রসব করার চেষ্টা করার সুযোগ থাকবে বা সফল স্বাভাবিক প্রসব হবে।
ষষ্ঠত, অনেকে আমাকে বলেন, প্রথম বাচ্চাটা আমি শখ করে সিজার করেছিলাম। এখন আমাকে স্বাভাবিক প্রসবের ব্যবস্থা করে দিন। আমি বলব, এই কাজ (শখ) কখনো করবেন না। প্রথম ডেলিভারীর পরিকল্পনা যখন করবেন তখন এমন ডাক্তারের শরণাপন্ন হোন বা ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করুন, স্বাভাবিক প্রসব (নরমাল ডেলিভারী) সম্ভব কিনা।
এমন ডাক্তার খুঁজে বের করুন যিনি অন্তত স্বাভাবিক প্রসবের চেষ্টা করবেন। যার প্রথম সন্তানটি স্বাভাবিক প্রসবে হয়, তার পরবর্তী সন্তান খুব সহজেই স্বাভাবিক ভাবে হয়। তাই প্রথম সন্তানের বেলায় সিজার এড়ানোটা পরবর্তীতে সিজার এড়ানোর ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখে। লেখক: ডা. কাজী ফয়েজা আক্তার (এমবিবিএস, এফআরসিপিএস, এমসিপিএস)। কনসালটেন্ট, ইমপালস হাসপাতাল। গাইনী ও প্রসূতি রোগ বিশেষজ্ঞ। উৎস: একুশে টেলিভিশন।