গত কয়েকদিন ধরেই দেশজুড়ে বেশ আলোচনার সৃষ্টি করেছে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ইমরান শরীফ ও জাপানের নাগরিক ডা. নাকানো এরি’কো দম্পতির দুই সন্তানের জিম্মা নিয়ে আইনি লড়াইয়ের বিষয়টি। দাম্পত্য কলহের জেরে বাবা-মা দুজনই চাইছেন তাদের দুই সন্তানকে নিজের কাছে রাখতে। বিষয়টা মি’মাংসার জন্য গড়িয়েছে হাইকোর্ট পর্যন্ত।
সবশেষ বাবা শরীফ ইমরানের জিম্মা থেকে দুই শিশু সন্তানকে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) কর্তৃক উদ্ধারের পর আ’গামী ৩১ আগস্ট পর্যন্ত তেজগাঁওয়ের ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে উন্নত পরিবেশে রাখার নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট।
হাইকোর্টের নির্দেশের পর রাজধানীর তেজগাঁওয়ের উইমেন সাপোর্ট সেন্টারে পুলিশের জি’ম্মায় আছে দুই শিশু। বুধবার (২৫ আগস্ট) ওই দুই শিশুকে ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারের পরিবর্তে একটি উন্নতমানের হোটেলে রাখার নির্দেশনা চেয়ে মৌখিক আবেদন করে’ছেন তাদের পিতার আইনজীবী ফাওজিয়া করিম।
আবেদনকারী ফাওজিয়া বলেন, ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে অস্বস্তিকর পরিবেশ থাকায় আদালতে তাদের জন্য হোটেলে রাখার ব্যব’স্থা চেয়ে আবেদন করেছি। হোটেলের খরচ প্রয়োজনে বাবা বহন করবেন বলেও আবেদনে বলা হয়েছে। এদিকে কেনো তাদের এই দাম্পত্য কলহ? কি কারণে দুই সন্তানের জিম্মা নিয়ে লড়াই চলছে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে? এ বিষয়ে দেশের শীর্ষস্থানীয় একটি গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেছেন দুই শিশু সন্তানের বাবা ইমরান শরীফ। তিনি বলেন, জাপানি নাগরিক নাকানো এরিকোর সঙ্গে ২০০৮ সালে তার বিয়ে হয়।
দাম্পত্য জীবনে তাদের ১১, ১০ ও ৭ বছর বয়সী তিনটি মেয়ে রয়েছে। কলেজ জীবন শেষে উচ্চতর ডিগ্রির জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তড়িৎকৌশল নিয়ে পড়তে যান ইমরান। পরে কর্মসূত্রে জাপানে এলে এরিকোকে বিয়ে করেন। এরিকো পেশায় চিকিৎসক। সপরিবার তারা টো’কিওতেই থাকছিলেন। তবে প্রায়ই পেশাগত প্রয়োজনে তাকে টোকিওর বাইরে যেতে হতো।
এর মধ্যেই তিনি একবার জানতে পারেন, তার স্ত্রী ও শ্বশুর টোকিওর বিলাসবহুল এলাকায় অ্যাপার্টমেন্ট কেনার পরিকল্পনা করছেন। ইমরানের দাবি, ভালোভাবে সবকিছু বুঝে ওঠার আগেই তার স্ত্রী ও শ্বশুর অ্যাপার্টমেন্টটি কিনে ফেলেন। ওই অ্যাপার্টমেন্টের মালিকানা তার ছিল না। তবু তাকে ৮০ শতাংশ ঋণ শোধ করার জন্য চাপাচাপি করেন স্ত্রী ও শ্বশুর।
বছর দেড়েক ঋণ শোধ করার পর তিনি অপারগতা জানালে তাকে অ্যাপার্টমেন্ট ছেড়ে দেয় চিঠি দেয়া হয়। এদিকে, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে শরীফ ইমরান মেয়েদেরকে যাতে তার কাছ থেকে জোর করে নিয়ে যেতে না পারেন সেজন্য বাংলাদেশের পারিবারিক আদালতে একটি মামলা করেন। মামলায় তিনি উল্লেখ করেন, ২০০৮ সালে টোকিওর একটি মসজিদে পারস্পরিক বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন তারা।
দাম্পত্য সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে তাদের বিবাহের পূর্ণতা লাভ করে। তাদের তিনটি কন্যাসন্তানের জন্ম হয়। সংসার জীবন শুরুর কিছুদিন পর অনুধাবন করেন নাকানো সংসার জী’বনে মোটেও আন্তরিক নয় এবং তিনি প্রচণ্ড একগুঁয়ে ও বদরাগী স্বভাবের। যার ফলশ্রুতিতে নাকানো তার ওপর যখন-তখন নানাভাবে মানসিক অত্যাচার করতেও দ্বিধা বোধ করতেন না।
নাকানো ইসলামিক ও বাঙালি সংস্কৃতি বিষয়ে একেবারেই উদাসীন। যদিও তিনি বিবাহের পূর্বে মুসলিম ধর্মে ধর্মান্তরিত হন। কিন্তু বিবাহের পর তিনি ঘো’ষণা করেন, তিনি কোনো ধর্ম মানেন না এবং তিনি সর্বদা নাবালিকা কন্যাদের ইসলাম ধর্ম পালনে অনুৎসাহিত করতেন। নাকানো নিয়মিত মদ্যপানকারী এবং তিনি বাসায় বিভিন্ন কোম্পানির মদের বোতল মজুত করে রাখেন। যদিও তিনি এই মর্মে আশ্বস্ত করে’ছিলেন যে, নাবালিকা সন্তানের সামনে বাড়িতে কখনো মদ পান করবেন না, বাড়িতে কোনো মদের বোতল থাকবে না।
কিন্তু তিনি বাড়িতে বসেই মদ্যপান করতেন। বাড়ির ফ্রি’জে সবসময় মদের বোতল মজুত থাকতো। নাকানোর মদ পানের বিষয়টি সন্তানরা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারেননি। ধর্মান্তরিত হওয়ার পরেও নাকানো শুধু মদ পান ক’রতেন না, তিনি নিয়মিত শূকরের মাংসও খেতেন। এ বিষয়ে প্রতিবাদ করায় নাকানোর সঙ্গে তার সম্পর্কের অবনতি ঘটে। এছাড়া, এরি’কো-ইমরান টোকিওতে একটি অ্যাপার্টমেন্টে বাস করতেন। একপর্যায়ে তিনি একটি অ্যাপার্টমেন্ট কিনেন।
অ্যাপার্টমেন্টের টাকার সিংহভাগই শরীফ অ্যাপার্টমেন্টের ৮৫% লোনের টাকা পরিশোধ করলেও এই অ্যাপার্টমেন্ট ছিল বিবাদী ও তার পিতার নামে। অ্যাপা’র্টমেন্টের ভাড়াটিয়া হিসেবে তাকে ভাড়াটিয়া চুক্তি করতে বাধ্য করেন। একপর্যায়ে উচ্চমূল্যের বাড়ি ভাড়ার টাকা পরিশোধের অক্ষমতা প্রকাশ করেন শরীফ। নাকানোর পি’তাকে টার্মিনেশন নোটিশ পাঠান। এতে নাকানো ক্ষিপ্ত হয়ে শরীফকে নানাভাবে চাপ প্রয়োগ করতে থাকেন।
এতে তাদের সম্পর্কের আরও অবনতি ঘটে। একদিন না’কানোর পিতা-মাতা একটি লিগ্যাল নোটিশ পাঠান যেখানে তারা অ্যাপার্টমেন্টে উচ্চহারে ভাড়া দাবি করেন এবং হুমকি দিয়ে বলেন- বর্ধিতহারে ভাড়া পরিশোধ না করলে অ্যা’পার্টমেন্ট থেকে বের করে দেয়া হবে তাকে। ২০২১ সালে নাকানোর কাছ থেকে আরেকটি নোটিশ পান শরীফ।
নোটিশে তালাক দাবি করা হয়। ওই নোটিশ পাওয়ার চার ঘণ্টার মধ্যে তারা সরাসরি অ্যাপার্টমেন্টে হাজির হন এবং শরীফকে বলেন চাবি দাও বের হয়ে যাও। চলতি বছরের ২১ শে ফেব্রুয়ারি জাপানি পুলিশকে ফোন করেন। কিন্তু পুলিশ ঘটনাস্থলে আসার পর নাকানোর অভিযোগের সত্যতা না পেয়ে তাদেরকে জানিয়ে দেন, জাপানি পুলিশ দেওয়ানি কোনো বিষয়ে হস্তক্ষেপ করবে না।
এই অব’স্থায় পুরো বিষয়টি তিনি নাবালিকা কন্যাদেরকে বুঝিয়ে বললে তারা সঙ্গে সঙ্গে বলেন, তারা তাদের পিতার সঙ্গে থাকবেন। নাকানো বিভিন্ন কৌশলে নাবালিকা সন্তা’নদের পাসপোর্ট লুকিয়ে রাখেন। বাধ্য হয়ে শরীফ তার প্রথম ও দ্বিতীয় নাবালিকা সন্তানের বাংলাদেশের পাসপোর্টের জন্য আবেদন করেন। এরপর প্রথম ও দ্বিতীয় নাবালিকা সন্তানদের নিয়ে গত ১৮ই ফেব্রুয়ারি দুবাই হয়ে বাংলাদেশে আসেন।