পৃথিবীতে অনেক ক’ঠিন কাজ আছে, তার মধ্যে অন্যতম ক’ঠিন একটি কাজ হলো সন্তান লালন-পা’লন। সন্তানের বেড়ে ওঠা এবং যাবতীয় আবদার মে’টাতে অধিকাংশ বাবা-মা ব্যতিব্যস্ত থাকেন। তাদের দু’চোখ জুড়ে থাকে স্বপ্নের খনি- তাদের সন্তান বড় হয়ে একদিন তাদের সেই স্বপ্ন পূর্ণ করবে, সমাজে তাদের মর্যাদা বাড়িয়ে দেবে। এত যখন প’রিকল্পনা, তখন সন্তানের ভালোর জন্য চাই বাড়তি যত্ন। তার খাওয়াদাওয়া, ঘুম, স্বা’স্থ্য, পড়ালেখা, বিয়েশাদি- সে এক মহাযজ্ঞের আয়োজন যেন! সব মা-বাবাই চান, তার সন্তানের পরবর্তী জীবনে সুখ আর সমৃদ্ধিতে ভরে উঠুক।
কিন্তু পারিবারিক, পারিপার্শ্বিক, মনস্তাত্ত্বিক ও অর্থনৈতিক কারণগুলোও সন্তানের বেড়ে ওঠার পেছনে গু’রুত্বপূর্ণ নিয়ামক হিসেবে কাজ করে। তাই অনেক সময় দেখা যায়, বাবা-মা’র সীমাহীন যত্ন আর দেখভাল সত্ত্বেও, অনেক শি’শুই বড় হয়ে ব্য’ক্তিগত জীবনে তেমন সফলতা পায় না। আবার প্র’চণ্ড অভাব-অবহেলার মধ্যে জ’ন্ম নিয়েও, বহু ছেলেমেয়ে একসময় নিজে’র ক্ষুদ্র গণ্ডি পেরিয়ে বড় সফলতার দেখা পায়।
তবে কি বাবা-মা’র যত্নআত্তির কোনো ভূমিকাই নেই সন্তানের বিকাশে? অবশ্যই আছে, কিন্তু শি’শুর প্রতি প্রতি বাবা-মায়ের দৈনন্দিন কিছু ভুল আচরণের কারণে সেই যত্ন যেতে পারে বিফলে, সন্তানের জীবন হতে পারে ব্য’র্থতামণ্ডিত। চলুন তবে জে’নে নিই, এমন কিছু ভুল আচরণ স’ম্পর্কে।
১. কর্তৃত্ব ফলানো: কোনো বাবা-মায়ের ইচ্ছা থাকে না যে, তার সন্তান বড় হয়ে ব্য’র্থ একজন মানুষে প’রিণত হোক। তারা সবসময়ই চান, তাদের সন্তানটি নি’রাপ’ত্তা পেয়েই বড় হোক। কারণ, সামনে তার পুরো একটা ভবিষ্যত প’ড়ে আছে।
নি’রাপ’ত্তা নিয়ে চিন্তা ভালো, বিশেষ করে আপনার সন্তান যখন শি’শু। তখন সত্যিকার অর্থেই বাড়তি নি’রাপ’ত্তার প্রয়োজন হয়। কিন্তু সন্তান যখন ক্রমাগত বড় হতে থাকে, তখন তার নি’রাপ’ত্তা নিয়ে আগের মতো ভাবার কিছু থাকে না। এটা একটা ভারসাম্যপূর্ণ আচরণ, কারণ সে যত বড় হয়ে ওঠে, ততই নিজে’র নি’রাপ’ত্তার ব্যাপারগুলো বুঝে নিতে শেখে।
একটা ছোট বাচ্চা আ’গুন দেখলে হয়তো এগিয়ে যেতে পারে, কিন্তু বয়স বাড়ার স’ঙ্গে-স’ঙ্গে সে বুঝে নেবে, আ’গুন তার জন্য বি’পদজনক। আপনি তখন বলে দিতে হবে না যে, আ’গুনে বি’পদ আছে! ভারসাম্য ব্যাপারটা এভাবেই গড়ে ওঠে। অথচ বাস্তবে দেখা যায়, ছোটবেলায় বাবা-মায়েরা নি’রাপ’ত্তার দোহাই দিয়ে সন্তানদের যেভাবে নজরবন্দী রাখতেন, সন্তান বড় হওয়ার পরও তাদের সেই আচরণ রয়ে যায়। সে কী করবে না করবে, কার স’ঙ্গে মিশবে, কী খাবে-না খাবে, কী পোশাক পরবে-না পরবে- এরকম শত ব্যাপার নিয়ে তারা মেতে থাকেন। এটা সহনীয় মাত্রায় প্রয়োজনীয়।
কিন্তু অনেক বাবা-মা ‘নি’রাপত্তা’র নামে সন্তানের ব্য’ক্তিগত জীবনেও হস্তক্ষেপ শুরু করেন। তারা বুঝতে চান না, তাদের সন্তান বড় হচ্ছে। তার নিজস্বতা বলে কিছু একটা গড়ে উঠছে, নিজে’র কিছু স্বপ্ন তৈরি হচ্ছে, হয়তো নিজে’র মতো জীবনের লক্ষ্যও রয়েছে তার। কিন্তু কথিত নি’রাপ’ত্তার নামে আপনি সন্তানের ভবিষ্যতকে দুর্বিষহ করে দিচ্ছেন না তো?
টেনেসি বিশ্ববিদ্যালয় ২০১১ সালের এক সমীক্ষায় দেখিয়েছে, ছোটবেলা পার করার পরও যেসব শি’শু কড়া নি’রাপত্তার চাদরের ভেতর রয়ে যায়, তারা পরবর্তী জীবনে আত্মকে’ন্দ্রিক, অত্যধিক স’চেতন, অল্পতেই ভে’ঙে পড়ার মতো পর্যায়গুলো পার করে। ছোট থেকে সি’দ্ধান্ত নেয়ার মা’নসিকতা গড়ে না ওঠায় সে পদে-পদে ভুল সি’দ্ধান্ত নেয়। স্বকীয়তা এবং আ’ত্মনির্ভরশীলতার মতো গু’রুত্বপূর্ণ দুটো ব্যাপার তার ভেতর অনুপস্থিত থেকে যায়। অন্যদের মতো তার নিজে’র প্রতি আত্মবিশ্বা’স থাকে না। যেগুলো তার পুরো জীবনকে প্র’ভাবিত করে।
অথচ প্রয়োজন ছিল, কীভাবে তার নিজে’র সি’দ্ধান্তগুলো নিজে নিতে পারে- সেটা শেখানো। ব্য’ক্তিগত পছন্দ-অপছন্দকে কীভাবে আরও ফলপ্রসূ করে তোলা যায়, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, মূল্যবোধের চর্চা তার ভেতর গেঁথে দেওয়া। তাহলেই সন্তান নিজে’র অব’স্থান থেকে একজন পরিপূর্ণ সফল মানুষ হয়ে ওঠার শ’ক্তি পাবে সবসময়।
২. বকাঝকা এবং অভিশাপ: শি’শু সন্তানকে বকাঝকা করা আমাদের সমাজে খুবই প্রচলিত একটি চিত্র। এটা সত্যি যে, বাবা-মা সন্তানের ভালো চান বলেই সন্তানের ক’র্মকাণ্ড নিয়ে চিন্তিত হন। ছোট অব’স্থায় তারা দুষ্টুমি করবেই, তাদের তাদের প্রকৃতি বা খেলাধুলার ধ’রনই এমন। তাই মাঝেমাঝে তারা হয়তো এমন কিছু করে বসে, যা আপনার সহ্যের সীমাকে ছাড়িয়ে যায়। আপনি দ্বিতীয়বার না ভেবে বলে বসেন, “অনেক হয়েছে; আজ তোর একদিন কি আমা’র একদিন”! এই বলে যা বলার বলে ফে’লেন! অনেক বাবা-মায়ের বদভ্যাস হচ্ছে একটু এদিক-ওদিক হলেই সন্তানকে অভিশাপ দিয়ে বসেন। এটা খুবই বাজে একটি ব্যাপার। আপনিই সন্তানের ভালো চান, আবার রেগে গিয়ে বলছেন, “তুই জীবনে কিছু ক’রতে পারবি না”!
মূলত শি’শু সন্তানের প্রতি বাবা-মায়ের আচরণের ধ’রনই সন্তান ভবিষ্যতে কেমন হবে, সেটা অনেকাংশে নির্ধারণ করে দেয়। সন্তানকে বকা দেয়া যেতেই পারে। কিন্তু তাকে শুধ’রে দেয়ার মন-মা’নসিকতা থেকে বকা দিচ্ছেন, নাকি কর্তৃত্ব ফলাতে বকা দিচ্ছেন- সেটা ভেবেছেন কখনো?
আপনার উচ্চারিত শব্দগুলো তাকে শুধ’রে না দিয়ে আরও একগুঁয়ে করে দিতে পারে, আপনার সাথে সন্তানের মা’নসিক দূ’রত্ব তৈরি ক’রতে পারে, তার ভেতর পরাম’র্শ না নেওয়ার মা’নসিকতা তৈরি করে দিতে পারে। গবেষণায়ও এমন ব্যাপারগুলো বারবার উঠে এসেছে।
৩. মা’রধোর করা: সন্তানকে শাসন করার অসংখ্য উপায় থাকতে পারে। কিন্তু শাসনের নামে গায়ে হাত তোলা আপনার শি’শুর জন্য ভালো কিছু বয়ে আনবে না। উন্নত বিশ্বে শি’শুদের শিষ্টাচার শেখানো, পড়াশোনায় মনোযোগী করে তোলা, বাবা-মায়ের অনুগত করে গড়ে তোলার জন্য দারুণ সব পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। শি’শু যদি কথা না শুনতে চায়, তবে তার চা’হিদার কথা শুনে নেওয়া জ’রুরি। রো’গী যেমন, তাকে ওষুধও দিতে হবে তেমন। তার মানে এই নয় যে, তাকে পিটিয়ে হলেও মানাবেন। শি’শুরা শা’রীরিক গঠনে এমনিতেই দু’র্বল, তাই অল্প গায়ে হাত তোলাতেও গু’রুতর শা’রীরিক জ’খমের আশ’ঙ্কা যেমন থাকে; তেমনি প্রহারজনিত কারণে শি’শুর মা’নসিক জগতেও আসে বড় ধ’রনের আঘা’ত।
একটা সময় দেখবেন, আপনার শি’শু তার ব্যাপারগুলো আপনার কাছে প্র’কাশ করছে না, যেগুলো স্বা’ভাবিকভাবে আপনাকেই জা’নানোর কথা। আপনি হয়তো পরিবর্তনগুলো খেয়াল করছেন না। কিন্তু সে তার মনোজগতের এই বিশাল পরিবর্তন বয়ে বেড়াবে ভবিষ্যত পর্যন্ত। তার কল্পনার জগতে আপনিই হয়ে যেতে পারেন সত্যিকার ভিলেন। ভালো-মন্দ যাচাই করার মতো খুব দক্ষ শি’শুরা হয় না, সেটা আপনাকেই শেখাতে হবে। আর তখনই তাকে শেখাতে পারবেন, যখন আপনি সন্তানের কাছে নির্ভরতার প্রতীক হতে পারবেন।
টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা প্রায় ৫০ বছরের গবেষণায় প্রায় দেড় লক্ষ শি’শুর ওপর গবেষণা করে দেখেছেন, যেসব শি’শুদের শারিরীকভাবে শা’স্তি দেওয়া হতো, তারা পরবর্তীতে পরিবেশ, প’রিস্থিতির সাথে খাপ খাইয়ে নিতে তেমন সফল হয়নি। তাছাড়া পরিপূর্ণ মা’নসিক বিকাশ বা’ধাগ্রস্ত হওয়ার কারণে অবসাদ, ভুল সি’দ্ধান্ত গ্রহণ, অপরাধমূলক ক’র্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ার ঘ’টনাও রয়েছে প্রচুর।
৪. ইলেকট্রনিক পণ্য ব্যবহারে অস’চেতনতা: যেসব বাবা-মায়েরা ইলেকট্রনিক জিনিসের প্রতি বেশি আসক্ত, তাদের সন্তানদের ভেতর পরবর্তীতে মা’নসিক বিভিন্ন স’মস্যা দেখা দেয়। পরিবর্তিত পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়াতে না পারা, অমনোযোগিতা, আলস্য- এসব শি’শুদের ভেতর জেঁকে বসে। বাবা-মায়েরা শি’শুকে যথেষ্ট সময় না দিলে তাদের কথা শিখতে দেরি হয়। গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব শি’শুদের বাবা-মায়েরা টিভি, স্মা’র্টফোনে আসক্ত, তাদের সন্তানের ভাষাগত দক্ষ’তা গড়ে উঠতে তুলনামূলক বেশি সময় লাগে।
কেবল বাবা-মা এগুলো থেকে দূ’রে থাকলেই হবে না, নি’শ্চিত ক’রতে হবে, সন্তানও যাতে এগুলা থেকে দূ’রে থাকে। বিশেষ করে বয়স দু’ বছর না হওয়া পর্যন্ত তাদেরকে টিভি, স্মা’র্টফোন-এগুলো থেকে দূ’রে রাখতে হবে। বিভিন্ন ভাষার সংমি’শ্রণ থেকেও বাচ্চাদের দূ’রে রাখতে হবে, কারণ তাদের অসুগঠিত মস্তিষ্ক এতে দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে প’ড়ে। ভাষা শেখানোর কাজটিও তাই সময়সাপেক্ষ এবং দুরূহ হয়ে প’ড়ে।
৫. ঘুমানোর সময় নির্ধারণ: বাড়ন্ত শি’শুদের মস্তিষ্কের কা’র্যকারিতা নির্ভর করে তাদের ঘুমের পরিমাণের উপর। বিশেষ করে সঠিক সময়ে ঘুমাতে যাওয়া শি’শুদের শেখার ক্ষ’মতা ও মনোযোগ, অনিয়মিত সময়ে ঘুমাতে যাওয়া শি’শুদের চেয়ে বেশি। ইংল্যান্ডের একদল গবেষক স’ম্প্রতি এমন তথ্য প্র’কাশ ক’রেছেন। কিন্তু বেশিরভাগ পরিবারেই শি’শুদের ঘুমানোর জন্য নির্দিষ্ট কোনো সময় নির্ধারণ করা হয় না। বিশেষ করে আমাদের যৌথ পরিবারগুলোতে এই স’মস্যা আরও বেশি। বাসার পরিবেশ তাই এমনভাবে তৈরি ক’রতে হবে, যাতে শি’শুর ঘুমানোয় ব্যাঘাত না ঘ’টে।
আপনার সন্তানের সুন্দর ভবিষ্যত নি’শ্চিত ক’রতে হলে, আপনাকেই আগে জানতে হবে, তাকে কীভাবে লালন-পা’লন ক’রতে হবে। নিজেদের বাস্তবতা ও সীমাবদ্ধতাগুলো জা’নিয়ে দিতে হবে, যাতে সে মা’নসিকভা’বে নিজেকে ক্রমাগত বদলাতে থাকা পৃথিবীতে টিকে থাকার জন্য তৈরি করে নিতে পারে। আপনার ব্যবহার আর শেখানো বিষয়গুলোই তার পরবর্তী জীবনের পাথেয়।