প্রতারণার মাধ্যমে গ্রাহকদের এক হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ইভ্যালির প্রধান ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা (সিইও) মোহাম্মদ রাসেল ও প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান তাঁর স্ত্রী শামীমা নাসরিন। ইভ্যালির অ্যাকাউন্টে বর্তমানে আছে মাত্র ৩০ লাখ টাকা। প্রতিষ্ঠার পর এত অল্প সময়ে এই বিপুল টাকা কোথায় গেল, তার হদিস এখনো মেলেনি।
গ্রাহকদের কষ্টার্জিত এই অর্থ কিভাবে ফেরত দেবেন, সে ব্যাপারে রাসেলকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল র্যাব। তবে কোনো ‘সদুত্তর’ পাওয়া যায়নি। আবার এই বিপুল অর্থের দায় মেটাতে ব্যর্থ হলে রাসেল ‘কম্পানি দেউলিয়া ঘোষণার’ পরিকল্পনাও করছিলেন। এ অবস্থায় গুলশান থানায় এক গ্রাহকের করা মামলায় গ্রেপ্তার রাসেল-শামীমা দম্পতিকে তিন দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। গতকাল শুক্রবার ঢাকা মহানগর আতিকুল ইসলামের আদালত এই রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
গত রাতে রাসেল অসুস্থ বোধ করায় তাঁকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়ার জন্য নিয়ে যাওয়া হয়।
প্রতারণা ও অর্থ আত্মসাতের বিষয়ে রাসেলকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে যেসব তথ্য পাওয়া গেছে, গতকাল সকালে সদর দপ্তরে এক সংবাদ সম্মেলনে এ বিষয়ে সাংবাদিকদের সামনে বিস্তারিত তুলে ধরেন র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, একটি প্রতিবেদনে গত ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ইভ্যালির দেনা ৪০৩ কোটি টাকা বলা হলেও ইভ্যালির সিইও রাসেল ও চেয়ারম্যান শামীমা নাসরিন প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছেন, গ্রাহকদের কাছে তাঁদের মোট দায় এক হাজার কোটি টাকার বেশি। গ্রাহকদের এই দায় মেটাতে ব্যর্থ হলে রাসেল ‘কম্পানি দেউলিয়া ঘোষণার’ পরিকল্পনা করেছিলেন।
সেই সঙ্গে বিপুলসংখ্যক গ্রাহক তৈরি করে ইভ্যালির ‘ব্র্যান্ড ভ্যালু’ বাড়ানোর পরিকল্পনাও ছিল তাঁর। ব্র্যান্ড ভ্যালু কাজে লাগিয়ে তিনি কোনো বিদেশি কম্পানির কাছে দায়সহ ব্যবসা বেচে দেওয়ার কথাও ভাবছিলেন। আবার তিন বছর পূর্ণ হলে শেয়ার মার্কেটে অন্তর্ভুক্ত হয়ে দায় চাপানোরও পরিকল্পনা ছিল তাঁর। সেই সঙ্গে ইভ্যালিকে একটি ব্র্যান্ড হিসেবে প্রতিষ্ঠার পর রাসেল কোনো আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান বা দেশি বড় প্রতিষ্ঠানের কাছে দায়সহ বিক্রি করে দেওয়ার একটি পরিকল্পনা করেছিলেন। এ ছাড়া বিভিন্ন সময়ে তিনি দায় মেটানোর অজুহাতে সময় নিয়েছেন, যা তাঁর একটি অপকৌশল মাত্র।
র্যাবের এক কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে জানান, নিজের কোনো পুঁজি না থাকলেও রাসেল পরিকল্পিতভাবে এই ব্যবসা করে আসছিলেন। ব্যবসাটি একটি পরিবার নিয়ন্ত্রিত হলেও শুরু থেকেই তাঁরা গ্রাহকদের সঙ্গে প্রতারণা করে আসছিলেন। প্রতিষ্ঠানের গঠনতন্ত্রে কোনো স্বচ্ছতা ছিল না। এ ছাড়া ছিল না কোনো জবাবদিহি। ফলে ক্রমান্বয়ে প্রতিষ্ঠানটির দায় বেড়ে বর্তমানে এই অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।
২০১৮ সালের ডিসেম্বরে যাত্রা শুরু করে মাত্র আড়াই বছরের মাথায় সরবরাহকারী কম্পানি ও গ্রাহকদের কাছে হাজার কোটি টাকার দায়ে পড়েছে ইভ্যালি। এত অল্প সময়ে এই বিপুল টাকা কোথায় গেল, তার হদিস মেলানো যাচ্ছে না। আত্মসাৎ ও পাচারের অভিযোগ অনুসন্ধানের অংশ হিসেবে গত জুলাই মাসে দুদকের আবেদনে ইভ্যালির শীর্ষ কর্তাদের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা জারি করেন আদালত। তাঁদের নেতিবাচক ব্যাবসায়িক ‘স্ট্র্যাটিজি’ উন্মোচিত হওয়ায় অনেক সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান এবং গেটওয়ে প্রতিষ্ঠান ইভ্যালি থেকে সরে যায়। দায় মেটাতে বিভিন্ন অজুহাতে সময় বাড়ানোর আবেদন রাসেলের একটি অপকৌশল।
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যের বরাত দিয়ে গতকাল সংবাদ সম্মেলনে র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন আরো বলেন, চলতি বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ইভ্যালির সম্পদ ছিল ৬৫ কোটি টাকা। অথচ নানা পণ্য বাবদ গ্রাহকদের কাছ থেকে অগ্রিম নেওয়া হয়েছে ২১৪ কোটি টাকা। গ্রাহকদের কাছ থেকে নেওয়া বিপুল অর্থের হদিস মিলছে না।
এ পর্যন্ত গ্রাহক ও অন্যান্য কম্পানির কাছে প্রতিষ্ঠানটির বকেয়া আছে ১৯০ কোটি টাকা। তবে ব্যক্তিগত সম্পত্তির পরিমাণ কয়েক কোটি টাকা হলেও ইভ্যালির অ্যাকাউন্টে বর্তমানে আছে ৩০ লাখ টাকা। এ ছাড়া প্রতিষ্ঠানটির ২৫ থেকে ৩০টি যানবাহন রয়েছে। ব্যক্তি পর্যায়ে সাভারে রাসেলের কয়েক কোটি টাকা মূল্যের জায়গা-জমিসহ অন্যান্য সম্পদ রয়েছে। আর কয়েকটি গেটওয়েতে ৩০ থেকে ৩৫ কোটি টাকা আটক হয়েছে আছে বলে জানিয়েছেন রাসেল।
র্যাবের ব্রিফিংয়ে আরো জানানো হয়, কম্পানির শুরুর দিকে প্রায় দুই হাজার স্টাফ ও অস্থায়ী ভিত্তিতে এক হাজার ৭০০ কর্মচারী কর্মরত ছিলেন এই প্রতিষ্ঠানে। এখন তা কমে এক হাজার ৩০০ স্টাফ এবং ৫০০ অস্থায়ী কর্মচারীতে নেমে এসেছে। বেতন বাবদ ইভ্যালির খরচ আগে পাঁচ কোটি টাকা হলেও এখন তা দেড় কোটিতে নেমে আসে। গত জুন থেকে অনেকের বেতন বকেয়া আছে।
অনেকের সঙ্গে রাসেলের যোগাযোগ থাকার বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে এই র্যাব কর্মকর্তা বলেন, ‘এটা রাসেলের মার্কেটিং পলিসি ছিল। দক্ষিণ এশিয়ায় ইভ্যালিকে সবাই এক নামে চিনবে—এমনটা রাসেল চেয়েছিলেন। তিনি মার্কেট ভ্যালু তৈরি করতে চেয়েছিলেন। সিএসআরের মাধ্যমে তিনি স্পন্সর করেছেন। বিভিন্ন জায়গায় প্রচার-প্রচারণা করেছেন। এই প্রচার-প্রচারণা সম্পূর্ণটাই সাধারণ জনগণের লগ্নি করা অর্থ দিয়ে করেছেন, লভ্যাংশ থেকে করেননি।
মাসে ১০ লাখ টাকা নিতেন রাসেল দম্পতি : ইভ্যালির সিইও মোহাম্মদ রাসেল পদাধিকারবলে মাসিক পাঁচ লাখ টাকা করে বেতন নিতেন। গত জুন মাস থেকে এ পর্যন্ত অনেক কর্মচারীকে বেতন দিতে না পারলেও পদাধিকার বলে প্রতি মাসে তিনি ও তাঁর স্ত্রী ইভ্যালি থেকে ১০ লাখ টাকা বেতন নিতেন। এ ছাড়া কম্পানির অর্থে ব্যক্তিগত দুটি দামি গাড়ি ব্যবহার করেতেন এই দম্পতি।
তিন দিনের রিমান্ড : সংবাদ সম্মেলন শেষে রাসেল ও শামীমা নাসরিনকে গুলশান থানায় নেওয়া হয়। সেখান থেকে দুপুর ২টায় তাঁদের আদালতে নিয়ে আসা হয়। বিকেল ৩টায় তাঁদের আদালতে তোলা হয়। মামলার সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে তাঁদের ১০ দিন করে রিমান্ডে নিতে আবেদন করেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা গুলশান থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মো. ওহিদুল ইসলাম। উভয় পক্ষের শুনানি শেষে আদালত তাঁদের তিন দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
আদালতের সামনে বিক্ষোভ : শুনানি শেষে রাসেল ও তাঁর স্ত্রীকে আদালত থেকে নিচে নামানোর পর ইভ্যালিতে অর্ডার দেওয়া ২০ থেকে ২৫ জন যুবক তাঁদের মুক্তির দাবিতে স্লোগান দিতে থাকেন। এ সময় কোতোয়ালি থানা পুলিশ তাঁদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। এ সময় সেখান থেকে আসাদ নামের একজনকে আটক করে নিয়ে যায় পুলিশ।
যেভাবে ইভ্যালিতে রাসেল : রাসেল একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স করে ২০০৯ সালে রাজধানীর একটি কোচিং সেন্টারে শিক্ষকতা শুরু করেন। দুই বছর এই শিক্ষকতা করার পর ২০১১ সালে একটি ব্যাংকে চাকরি নেন। ছয় বছর সেখানে চাকরি করার পর ২০১৭ সালে নিজেই ব্যবসায় নামেন। এর মধ্যে ২০১৩ সালে একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিএ করেন।
২০১৭ সালে চাকরি ছেড়ে ডায়াপারের ব্যবসা শুরু করেন। আর ২০১৮ সালে চালু করেন ইভ্যালি। এর পর থেকে আঙুল ফুলে কলাগাছ বনে যান রাসেল। গত বৃহস্পতিবার বিকেলে রাজধানীর মোহাম্মদপুরের স্যার সৈয়দ রোডের বাসা থেকে রাসেল ও তাঁর স্ত্রীকে গ্রেপ্তার করা হয়। এরপর তাঁদের র্যাব সদর দপ্তরে নেওয়া হয়। গতকাল শুক্রবার গুলশান পুলিশের কাছে তাঁদের হস্তান্তর করে র্যাব।