বিয়ের পর শ্বশুরবাড়িতে যেসব সমস্যা হয়- জানালেন ৭ জন ভুক্তভোগী নারী

বিয়ের সঙ্গে জড়িয়ে আছে বেশ কিছু বিষয়। কেউ প্রেমের সম্পর্কে থাকার পর বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেয়, কেউ আবার বিয়ে করে বাবা-মায়ের পছন্দে। যতই যাই হোক না কেন, বিয়ের আগে ও পরে – জীবনের এই দুটি পর্বের মধ্যে মিল খুব কম।

আইবুড়ো থাকার সময় জীবনকে অন্যভাবে দেখে মানুষ। কিন্তু ম্যারেজ রেজিস্ট্রারের খাতায় সই করার পরই জীবনটা আর আগের মতো থাকে না। পুরোপুরি পালটে যায়। বিশেষ করে পালটে যায় মহিলাদের ক্ষেত্রে। কথাটা শুনে পুরুষরা রেরে করে উঠবে ঠিকই, কিন্তু ভালো করে ভেবে দেখুন, মহিলাদেরই সমস্যা হয় বেশি। তার কারণ আমাদের সমাজ ব্যবস্থা। সব ছেড়ে মহিলাদেরই স্বামীর ঘর করতে আসতে হয়। কেমনই সদ্য বিবাহিত ৭জন মহিলার সঙ্গে কথা বলল ইনাডু ইন্ডিয়া বাংলা –

১. “বিয়ের প্রথম কয়েক সপ্তাহ আমার শাশুড়িমা আমার সাজ পোশাক নিয়ে খুব চিন্তিত ছিলেন। আমি শহুরে শিক্ষিত মেয়ে। ৭-৮ বছর কর্পোরেট অফিসে কাজ করেছি। ব্যাপারটা আমার কাছে ঠিক বোধগম্য হত না। আমি কী শাড়ি পড়ব, কী গয়না পড়ব, কেমন মেকআপ করব – এসব তুচ্ছ ব্যাপারে আমার শাশুড়িমা সাংঘাতিক রকম বিচলিত ছিলেন। তার উপর নিত্যদিন বাড়িতে অতিথি সমাগম হত। সকালে ঘুম থেকে ওঠার পরই শাশুড়িমা বলতেন, আজ ওমুক কাকিমারা আসবেন, কাল তমুক মামারা আসবেন।

অতিথিদের জন্য চা-টা নিয়ে আসতে হবে আমাকেই। আমার সঙ্গে সকলের ভালো আলাপপরিচয় হবে। তাই সেজেগুজে ফিটফাট হয়ে থাকতে হবে। পায়ে আলতা, কপালে গনগনে সিঁদুর পরতে হবে। আঁচল দিতে হবে মাথায়। সবাইকে দেখামাত্রই পায়ে হাত দিয়ে ঢিপঢিপ করে প্রণাম করতে হবে। হাতের শাখা-পলা খোলা যাবে না। মাথার চুল কাটা যাবে না একবছর। আর সকালে উঠেই স্নান সেরে ভালো কাপড় পরে সাজতে হবে সুন্দর করে। অতিথিরা যাতে আমার লক্ষ্মীমন্ত মুখ দেখে চোখ ফেরাতেই না পারে। তাতেই নাকি বাড়ির সম্মান। আর কোনও কিছুতে নয়।”

২. “বিয়ের পর আমার জন্য নতুন ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খুলে দিল আমার স্বামী। আমি মধ্যবিত্ত বাড়ির মেয়ে। বিয়ে হয়েছে উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবারে। স্বামীর ভালো চাকরি। নিজস্ব বাড়ি-গাড়ি। আমিও চাকরি করতাম। বিয়ের পর ছেড়ে দিই। সেখানেই ভুল করে ফেলি। মেয়েরা অর্থিক স্বাধীনতা হারালে সকলের কাছে বোঝা হয়ে যায়। আমার পদবি দত্তগুপ্ত।

বিয়ে হয়েছে চৌধুরী পরিবারে। ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খোলার সময় কাগজে দত্তগুপ্ত পদবিটাই লিখে ফেলি। ইচ্ছে ছিল, বিয়ের পরও এতদিনের ব্যবহার করা বাবার দেওয়া পদবি রাখব। ফলত, সই করে দিই। আর তখনই বুঝতে পারি স্বামী ও পরিবারের হাবভাব। বুঝতে পারি আমার নিজস্ব কোনও পরিচয় নেই। ইচ্ছে থাকলেও আমি আমার হারিয়ে যাওয়া পদবিটা ফিরে পেতে পারব না।”

৩. “বিয়ের আগে প্রেম করেছিলাম ৩ বছর। প্রেমিক থাকাকালীন আমার স্বামী খুব রোম্যান্টিক ছিল। ব্যস্ততর কর্মজীবনের ফাঁকেও আমার জন্য সময় ছিল অধেল। ব্যবহার ছিল মধুর। আমি ওর প্রেমে আত্মহারা হয়ে যাই। সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি বিয়ে করলে ওকেই করব, নচেৎ নয়। আমার ইচ্ছেমতোই সবকিছু এগোয়। কিন্তু বিয়ের ৬ মাস পর থেকে ওকে আমি আর আগের রূপে ফিরে পাই না।

নিজেকে পুরোপুরি পালটে ফেলে আমার স্বামী। রোম্যান্টিকতা তো দূর, সাধারণ খাতিরযত্ন করা থেকেও মুখ ফিরিয়ে নেয় সে। এখন নিজেকে তাচ্ছিল্যের পাত্রী ছাড়া আর কিছুই মনে হয় না আমার। মাঝেমাঝে মনে হয় বিয়েটাই ভুল ছিল। যেমন চলছিল, তেমনই যদি চলতে দিতাম ভালো হত। এখন বুঝি, বিয়ের আগে মনে যতই প্রেমের ফুল ফুটুক না কেন, পরিচর্যা না পেলে ফুল শুকিয়ে যায়। সেটাই হল বাস্তব সত্যি।”

৪. “বিয়ের পরও চাকরি থেকে বিরতি নিইনি আমি। সংসার ও চাকরি সমানতালে চালিয়ে যাচ্ছি। এটা করার জন্য আমার স্বামী ধরেই নিয়েছে, সে আমার জন্য কোনওরকম খরচ করবে না। সত্যি বলতে কী, আমি আমার স্বামীর মতো বিপুল টাকা উপার্জন করি না। যা টাকা পাই, আমার ভালোমতো চলে যায়। ওর অফিসের সঙ্গে আমার অফিসের সময়েরও মিল নেই। আমার শিফ্টিং ডিউটি। ৩ ঘণ্টা আগে বেরোতে হয় আমাকে। কোনওদিনই ও আমাকে অফিসে ছেড়ে দিতে পারে না।

পাবলিক ট্রান্সপোর্টে করে যেতে হয় অফিসে। সম্প্রতি একটা গাড়ি কেনার কথা বলি আমার স্বামীকে। সত্যি বলতে কী, আমি চাইছিলাম ও আমাকে কিছু সাহায্য করুক। কিন্তু না, সরাসরি বলে দিল চাকরিবাকরি করি যখন, নিজের প্রয়োজন নিজের পয়সাতেই মেটাতে হবে। আমার স্যানিটারি ন্যাপকিনের পয়সাটাও আমাকে দেয়নি কখনও। অথচ ও একজন চাকুরিরতা মেয়েকেই বিয়ে করতে চেয়েছিল। এখন বুঝি, বিয়ের পর আমাকে কোনওরকম আর্থিক সাহায্য করবে না বলেই হয়তো এমনটা চেয়েছিল।”

৫. “বিয়ে আগে প্রেম করতাম যখন ঝগড়া-অশান্তি হলে দুশ্চিন্তার শেষ থাকত না। খালি মনে হত ছেড়ে চলে যাবে। কিন্তু বিয়ের পর বুঝলাম, ঝগড়া হলে সেটা কত সহজে মিটে যেতে পারে। নিজের অভিজ্ঞতা দিয়ে বলছি, ঝগড়ার মোক্ষম দাওয়াই আদর। সারাদিন যতই ঝগড়া করুন, মধ্যরাতের আচমকা মিলনে সব রাগ-অভিমান কান্না হয়ে বেরিয়ে যায়। পরদিন সকাল থেকে সব শান্ত, আগের মতো।”

৬. “আমি স্বাধীনচেতা। আর স্বাধীনচেতা মানুষের বিয়ে করা উচিত না। এই সত্যিটা বুঝতে পারি বিয়ের পর। আমার শ্বশুরবাড়ি ভীষণ রক্ষণশীল। সারাক্ষণ কেউ না কেউ গর্জাচ্ছে, চমকাচ্ছে। আমি বাবা-মায়ের একমাত্র মেয়ে। খুব আদরে মানুষ। বাবা-মা কোনওদিন আমাকে কোনওকিছুতে আটকায়নি। শুধু বিয়েটা তাঁদের ইচ্ছেতে করতে হয়েছে। আর সেখানেই আমার জীবনের নরকসিদ্ধান্ত। আমার স্বামী শান্ত প্রকৃতির মানুষ। নিজের জগতে ব্যস্ত থাকে। সাতে-পাঁচে ওর রা নেই।

এমন স্বভাব দেখেই বিয়েতে রাজি হই। কিন্তু ও যত শান্ত, ওর বাড়ির লোক ততই অশান্ত। বিশেষ করে আমার শ্বশুরমশাই। বাড়িটা সংসার না মিলিটারি ক্যাম্প এখনও বুঝে উঠতে পারিনি। আইনশৃঙ্খলা ছাড়া কিচ্ছু নেই। ঘড়ি বেঁধে সব কাজ হয়। বিয়ের আগে আমি একা একা বেড়াতে চলে যেতাম ৩-৪ দিনের জন্য। চাকরিবাকরি করতাম। নিজের সিদ্ধান্ত নিজেই নিতাম। আমার উপর কেউ হুকুম ফলাতে আসত না। বিয়ের পর আমার জীবন থেকে সব হারিয়ে গেছে। এখন সবকিছুই আছে। খালি আমার নিজের অস্তিত্ব নেই।”

৭. “মা-বাবাকে দেখিনি একবছর হয়ে গেছে। আমি দিল্লির মেয়ে। বিয়ে হয়েছে কলকাতায়। পাঁচ বছর আগে। এই পাঁচ বছরে বাবারবাড়ি গেছি মোটে তিনবার। আমার শ্বশুরবাড়িতে এমনিতে কোনও সমস্যা নেই। সবাই খুব ভালো। কিন্তু মা-বাবার সঙ্গে দেখা করতে যেতে চাইলেই সকলের মুখ ছোটো হয়ে যায়। আচ্ছা, বিয়ের পর কেন মেয়েদের একজন সম্পূর্ণ অজানা ছেলের মা-বাবার সেবা করতে হবে, নিজের মা-বাবাকে ছেড়ে?”

About reviewbd

Check Also

বাংলাদেশের ইলিশ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে কলকাতাবাসী

প্রধানমন্ত্রীর উপহার হিসেবে শুক্রবার থেকে কলকাতার বাজারে আসতে শুরু করেছে বহুল প্রতীক্ষিত বাংলাদেশের ইলিশ। তবে …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *