ইসলাম ধর্ম পালনকারীদের জন্য রমজান খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি মাস। পুরো একমাস দিনের একটি নির্দিষ্ট সময় খাবার গ্রহণ থেকে বিরত থাকতে হয়। আরো অন্যান্য অনেক বিধিনিষেধও আছে বটে, কিন্তু এটাই বেশি লক্ষণীয়।
রমজানের রোজা রাখা ইসলামের মূল পাঁচ ভিত্তির একটি। এটা ফরজ। তবে শুধু রমজানের রোজাই নয়; সাপ্তাহিক, মাসিকসহ আরো বিভিন্ন সময়ের জন্য নফল রোজারও বিধান আছে।
শুধু ইসলাম ধর্মেই নয়, অন্যান্য ধর্মেও মোটামুটি একই রকমের বিধান পালনের নির্দেশ আছে- মানে বিশেষ দিনে নির্দিষ্ট কিছু সময়ে না খেয়ে থাকা বা সীমিত কিছু খাদ্যগ্রহণ করা।
শুধুই ধর্মীয় বিধানপালনের জন্যই রোজা রাখা, নাকি এর পাশাপাশি স্বাস্থ্যগত উপকারও আছে? এ নিয়ে বিশ্বব্যাপী নানা গবেষণা হয়েছে। সেসব গবেষণা রোজার বিবিধ মানসিক ও শারীরিক উপকারিতা নিয়ে কী বলছে দেখে নিন-
রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়
‘ফ্রি র্যাডিকেল’ হলো সেইসব বর্জ্য পদার্থ যেগুলো অশুদ্ধ খাবার, বাতাস ইত্যাদির মাধ্যমে শরীরে জমা হয়। এরাই হচ্ছে বিভিন্ন রোগের জন্মদাতা বা আমন্ত্রণকারী। যার শরীরে যত বেশি ফ্রী র্যাডিকেল জমা হয়ে আছে, রোগের বিরুদ্ধে তার প্রতিরোধ ক্ষমতা ততই দূর্বল। রোজা রাখার ফলে এই সব ফ্রি র্যাডিকেলের মাধ্যমে শরীরে তৈরি হওয়া বিভিন্ন ক্ষতির পরিমান হ্রাস পায়। এছাড়া রোজা বিভিন্ন প্রদাহের সুরাহা করে, এমনকি ক্যান্সার কোষ গঠনেও বাধা তৈরি করে।
বাড়িতে পোষা জীবজন্তু থাকলে লক্ষ্য করলে দেখবেন, এরা অসুস্থ হলে খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে দেয় ও শরীরকে যথেষ্ট বিশ্রাম দেয়। রোগাক্রান্ত শরীরকে তার আপন নিয়মে সুস্থ করার জন্য এটা একটা প্রকৃতিপ্রদত্ত মৌলিক উপায়। খাবার প্রক্রিয়াজাত করতে শরীরকে কঠিন পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে যেতে হয়; শরীর যখন এই কাজের চাপ থেকে বিরতি পায় তখন সে অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের দিকে খেয়াল দেয় ও বিভিন্ন ক্ষতির মেরামত করার চেষ্টা করে। ফলে রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা আরো জোরদার হয়। আমরা অনেকেই সুস্থ অথবা অসুস্থ শরীরকে সব সময় ব্যতিব্যস্ত করে রাখি অতিরিক্ত খাবার খেয়ে; ফলে অসুস্থ অথবা সুস্থ হওয়াকে বিলম্বিত করি।
দীর্ঘজীবন লাভের পথ
সীমিত খাদ্যগ্রহণ দীর্ঘ জীবন লাভে সহায়ক। দীর্ঘ জীবন লাভকারী নির্দিষ্ট কিছু জনগোষ্ঠীর মানুষের ওপর গবেষণা করে দেখা গেছে, মূলত তাদের খাদ্যাভাসেই লুকিয়ে আছে দীর্ঘজীবী হবার রহস্য। তারা নিয়মতান্ত্রিকভাবে পরিমিত খাদ্যগ্রহন করে থাকে। রোজা আমাদের এমনি একটি পথের দিশা দেখায়।
মস্তিষ্ককে আরো কার্যক্ষম করে
রোজা রাখার ফলে মস্তিষ্ক আরো কার্যক্ষম হয়ে ওঠে। দেখা গেছে যে, একটা নির্দিষ্ট সময়ব্যাপী না খেয়ে থাকলে শরীরে ‘ব্রেইন ড্রাইভড নিউরোপ্যাথিক ফ্যাক্টর (বিডিএনএফ)’ নামে একটি প্রোটিনের উৎপাদন বেড়ে যায়। এটা মস্তিষ্কের স্টেম সেলকে (কুঁড়ি কোষ – যেটা পরবর্তীতে প্রয়োজন মাফিক অন্য কোষে রুপান্তরিত হতে পারে) প্রণোদনা যোগায় নতুন নিউরন কোষে রূপান্তরিত হতে। এছাড়াও, অন্যান্য প্রয়োজনীয় জৈব রাসায়নিক পদার্থের ক্ষরণ ঘটিয়ে স্নায়ুতন্ত্রকে ভালো রাখে এই প্রোটিন। পাশাপাশি নানাবিধ স্নায়বিক ও মানসিক বৈকল্য জনিত রোগ, যেমন আলঝেইমার্স বা পারকিনসন্সের প্রভাব থেকেও মস্তিষ্কের কোষকে রক্ষা করে থাকে।
বিপাক ক্রিয়ার উন্নতি ঘটায়
সারা বছর প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে আমরা খেয়েই যাই। কখনো কি ভেবেছি পাকস্থলির কথা? সে সারাক্ষণ শুধু আমাদের গলধঃকৃত খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণেই ব্যস্ত থাকে। কাজের মাঝে বিশ্রাম যেমন আমাাদের পুনরুজ্জীবিত করে ও পরবর্তীতে আমরা আরো ভালোভাবে কাজ করতে পারি, ঠিক তেমনি আমাদের শরীরের কিছু কিছু আভ্যন্তরীণ তন্ত্রও বিশ্রামের ফলে আরো কর্মক্ষম হয়ে ওঠে। রোজা রাখার ফলে একটা দীর্ঘসময়ব্যাপী পাকস্থলী থেকে শুরু করে গোটা খাদ্য পরিপাকতন্ত্র বিশ্রাম পায়। এর ফলাফল স্বরূপ পরবর্তীতে এটার কাজে আরো গতি পায়, মানে ক্যালোরি থেকে শক্তি উৎপাদন প্রক্রিয়া আরো ভালোভাবে সম্পন্ন করতে পারে। এছাড়া রোজা রাখার ফলে হজমশক্তি বাড়ে। এভাবে আমাদের শরীরের পুরো বিপাক ক্রিয়ার উন্নতি ঘটে ও ইতিবাচক প্রভাব লক্ষ্য করা যায়।
ওজন কমায়
বাড়তি ওজন বর্তমান জীবনের একটি বিরাট সমস্যা। অনিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভ্যাস, ব্যায়ামহীন জীবন মূলত এর জন্য দায়ী। বাড়তি ওজন শরীরে ডেকে আনে বাড়তি রোগের যন্ত্রণা। বেঁচে থাকার জন্য আমাদের শক্তির প্রয়োজন। শরীর এই শক্তি উৎপন্ন করে খাবার নামক জ্বালানি থেকে, মূলত শর্করা থেকে। রোজা থাকাকালীন সময় যেহেতু শরীরে বাহ্যিক জ্বালানি সরবরাহ বন্ধ থাকে, তখন শরীরের নিজের জমানো চর্বি ভেঙ্গে শক্তি উৎপন্ন করে। এভাবে শরীরে জমে থাকা বাড়তি চর্বি ক্ষয় হয়ে ওজন কমে যায় এবং ঝরঝরে হয়ে ওঠে। তবে অবশ্যই ইফতারে ও রাতের খাবারেও পরিমিতি আবশ্যক। সারাদিন কিছু খাইনি এই অজুহাতে ইফতারে, রাতের খাবারে একগাদা খেয়ে ফেললে যে সব উদ্দেশ্যই মাটি! না তাতে রোজার ধর্মীয় উদ্দেশ্য ‘সংযম’ পালিত হয়, না রোজার শারিরীক উপকারিতাটুকু লাভ করা যায়।
সত্যিকারের ক্ষুধাবোধ তৈরি করে
সত্যিকারের ‘ক্ষুধা’ কাকে বলে তা আসলে আমরা খুব কম জানি। কারণ ঠিকমতো ক্ষুধাবোধ তৈরি হবার আগেই আমরা গাদা গাদা খাবার খেয়ে ফেলি। ফলে সত্যিকারের ‘ক্ষুধা’ ও খাবার গ্রহণের ‘তৃপ্তি’ আমাদের অজানাই থেকে যায়। রোজা রাখার ফলে শরীরে সুষমভাবে হরমোন ক্ষরিত হয় এবং আমরা ক্ষুধাকে বোধ করতে পারি। ‘ক্ষুধা’ লাগা মানে শরীর খাবার চাচ্ছে এবং এই সময়টাতে শরীর পরিপূর্ণভাবে তৈরি থাকে খাবারগ্রহণ ও প্রক্রিয়াজাত করার জন্য। সুতরাং এই সময়ে গৃহীত খাবারটা ঠিকঠাক মতো হজম হয় ও বিপাক ক্রিয়াও সুষ্ঠুভাবে চলে।
নিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভাস তৈরি করে
আমরা প্রায় সবাই-ই যখন তখন খাবার খেয়ে ফেলি- শুধু নাগালে থাকলেই হল। আবার অনেকেই কাজের চাপে ও বিভিন্ন কারনে খাবার গ্রহণে অনিয়ম করে। এসব অভ্যাস স্বাস্থের জন্য মোটেও ভালো নয়। একটি নিয়মিত খাদ্যাভ্যাস আমাদেরকে সুস্থ থাকতে সাহায্য করে; রোজা রেখে যেমনটা অনুশীলন করি আমরা। একটি নির্দিষ্ট সময়ে শরীরের প্রয়োজনীয় ক্যালোরিটুকু গ্রহণ করা আবার একটা লম্বা সময়ের জন্য খাদ্যগ্রহণ থেকে বিরত থাকার ফলে পুরো শরীর একটি চমৎকার ছন্দময় নিয়মের মধ্য দিয়ে যায়। নিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভ্যাস তৈরি করার জন্য এর চেয়ে ভালো উপায় কী আর আছে!
ইনসুলিনের কার্যকারিতা বাড়ায়
রোজা রাখার ফলে শরীরের ইনসুলিনের কার্যকারিতা বেড়ে যায়। শরীর আরো ভালোভাবে শর্করা গ্রহণ করতে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে, রোজার পরে ইনসুলিন বেশি কার্যকরী হয়, এটি তখন রক্ত থেকে গ্লুকোজ গ্রহণ করতে শরীরকে নির্দেশ দেয়। ফলে ডায়াবেটিস রোগীর জন্য রোজা রাখা অনেক ফলদায়ক।
ত্বকের জন্য উপকার
এক গবেষণায় দেখা গেছে, এক দিনের রোজাও শরীরের দূষিত পদার্থ বা টক্সিনকে পরিস্কার করে দিতে পারে। এছাড়াও রোজা রাখার ফলে শরীরের অন্যান্য অঙ্গসমূহের, যেমন লিভার, কিডনির কার্যক্রম ঠিকঠাকমতো চলে। এইসবের সম্মিলিত কাজের ফলে ত্বক আরো সুন্দর হয়।
আত্মোপলব্ধি বাড়ায়
পেটে দানাপানি না থাকলে অনুভূতি প্রখর হয়, শুনতে কেমন শুনালেও কথা সত্যি। পেটের খাবার হজম করতে শরীরকে বেশ সময় ও শ্রম ব্যয় করতে হয়। রোজা রাখার ফলে যেহেতু হজম করার প্রক্রিয়া থেকে মুক্তি মেলে, শরীরে কিন্তু অনেকটাই এনার্জি থেকে যায়। এই বাড়তি এনার্জি শারিরীক ও আত্মিকভাবে ভালো লাগার একটা অনুভূতি তৈরি করে। হালকা শরীর ও পরিস্কার মন তখন যৌথভাবে আরো তীক্ষ্ণ অনুভূতির জন্ম দেয়। আমরা অনেক কিছু গভীরভাবে বোঝার সক্ষমতা অর্জন করতে পারি।
রোজার শুধু ধর্মীয় বিধিপালনগত লাভই নয়, উপরন্তু আরো অনেক উপকারিতা রয়েছে। তাই আরো দ্বিগুণ উৎসাহ নিয়ে রোজা রাখুন ও আত্মিক, শারীরিক, মানসিক ভাবে ভালো থাকুন।