নিয়ম করে মাঠে এসে খেলা দেখছেন, বাংলাদেশের টানা হারে ব্যথিত না হওয়ারও কোনো কারণ নেই। বাকি দুটি খেলাও মাঠে বসে দেখেই দেশে ফেরার ইচ্ছা বোর্ড পরিচালক নাঈমুর রহমানের। বিরতির সময়টা ঘুরে-ফিরে পার করলেও বাংলাদেশের প্রথম টেস্ট অধিনায়ক অবশ্য এখানে আসা বোর্ডে তাঁর অন্য সহকর্মীদের মতোই আশ্চর্য রকম নীরব। না জানাচ্ছেন কোনো প্রতিক্রিয়া, না করছেন কোনো মন্তব্য। মুখে কুলুপ এঁটে থাকার সতর্কতার মধ্যেও তাঁর লুকানো অভিমান ঠিকই প্রকাশিত, ‘আমাকে দিয়ে কথা বলিয়ে গালমন্দ খাওয়াতে চাচ্ছেন কেন?’
ঠিক গালমন্দ না শুনলেও গত কিছুদিনে যা যা শুনেছেন, তাতে অভিমানের বরফ এমন জমাট বেঁধেছে যে তা আর গলছেই না। পাছে নতুন কিছু না আবার শুনতে হয়, এই আশঙ্কায় ক্রিকেটার থেকে প্রশাসক হওয়া নাঈমুররা আর কোনো কথাই বাড়াচ্ছেন না। এমনকি জাতীয় দলের দেখভাল করা কমিটির প্রধান আকরাম খানও চুপটি মেরে গেছেন একেবারে।
ওমানের মাসকাটে স্কটল্যান্ডের কাছে বাছাই পর্বের ম্যাচ হারার পরদিনই বোর্ড সভাপতি নাজমুল হাসান সংবাদমাধ্যমের সামনে সিনিয়র ক্রিকেটারদের নিয়ে যে তীব্র সমালোচনায় মেতেছিলেন, সেটিই আসলে খুলে দেয় বোর্ড-ক্রিকেটার মুখোমুখি অবস্থান নেওয়ার পথ। ওমানকে হারানোর পর থেকেই এর জের টানা শুরু। সেদিন ম্যাচের পর সাকিব আল হাসানের সংবাদ সম্মেলনে প্রায় প্রতিটা প্রশ্নের জবাবেই ছিল উষ্ণতা।
তখনই কারণ বোঝা না গেলেও প্রশাসকদের ওপর ক্রিকেটারদের চটে থাকার ব্যাপারটি বোঝা যায় পাপুয়া নিউ গিনিকে হারানোর পর। মুখ খোলেন অধিনায়ক মাহমুদ উল্লাহ। আর সুপার টুয়েলভ পর্বে নিজেদের প্রথম ম্যাচে শ্রীলঙ্কার কাছে হারের পর সমালোচকদের আয়নায় মুখ দেখার পরামর্শ দিয়ে পাল্টা আঘাত হানেন মুশফিকুর রহিমও।
তাঁর কথার লক্ষ্যবস্তু কারা ছিলেন, প্রশাসকদের এই সময়ের নীরবতাই সেটি আরো স্পষ্ট করে তুলেছে। তাঁরাও নতুন কোনো বিতর্ক উসকে না দিয়ে বরং বিশ্বকাপের বাকি দুই ম্যাচ শেষে ঘরে ফেরার অপেক্ষায়। তবে অভাবের সংসারে যেমন নিত্য টানাপড়েন লেগেই থাকে, তেমনই অবস্থা যেন বাংলাদেশ দলেরও। বোর্ড-ক্রিকেটার মুখোমুখি অবস্থানের আগুনে ঘি ঢালতে যে এবার যোগ দিয়েছেন রাসেল ডমিঙ্গোও। বিশ্বকাপ শেষে দেশে ফেরার কিছুদিনের মধ্যেই পাকিস্তানের বিপক্ষে হোম সিরিজ।
সেই সিরিজ সামনে রেখে অনুশীলনের সূচি নির্ধারণ করা নিয়েই ভেতরে ভেতরে লেগে গেছে ক্রিকেট অপারেশনস কমিটির প্রধান আকরাম আর জাতীয় দলের হেড কোচের মধ্যে। ১২ নভেম্বর থেকে অনুশীলন শিবির করার তারিখ ঘোষণা করে দিয়েছেন আকরাম। এটা আবার ভালোভাবে নিতে পারেননি ডমিঙ্গো। এর প্রতিক্রিয়ায় এই প্রোটিয়া কোচ পাল্টা যা করেছেন,
তা-ও বোর্ডের অনেকের চোখে ‘ঘোড়া ডিঙিয়ে’ যাওয়ার মতো ব্যাপারই। আকরামের সঙ্গে নয়, ডমিঙ্গো সরাসরি যোগাযোগ করেছেন বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা নিজাম উদ্দিন চৌধুরীর সঙ্গে। হেড কোচের কথায় জবাবদিহি চাওয়ার সুরই ছিল বলে জানা গেছে নির্ভরযোগ্য সূত্রে। প্রধান নির্বাহীর কাছে ডমিঙ্গোর প্রশ্ন এ রকম হয়ে থাকলে তো উত্তাপ ছড়ানোরই কথা, ‘কার অনুমতি নিয়ে অনুশীলন শিবিরের সূচি ঠিক করা হলো?’
এমনিতে জাতীয় দলের জন্য যেকোনো পরিকল্পনা ঠিক করার আগে হেড কোচের সঙ্গে আলাপ করে নেওয়ার রেওয়াজ আছে। তাঁর পরামর্শকে গুরুত্বও দেওয়া হয়। দলের টানা হারে এবার সেই গুরুত্ব হারানো ডমিঙ্গো দুবাইতেই অবস্থান করা আকরামের সঙ্গে কথা না বলে শরণাপন্ন হন দেশে থাকা প্রধান নির্বাহীর, যা নিয়ে দলের বাজে সময়ের মধ্যেও আরেক দফা বিষবাষ্প ছড়ানো স্বাভাবিক। সময় প্রতিকূল বলেই হয়তো এ বিষয়ে ঝাঁজালো প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেল না আকরামের। তবে অনুশীলন সূচি নিয়ে প্রধান নির্বাহীর সঙ্গে ডমিঙ্গোর সরাসরি যোগাযোগের বিষয়টি স্বীকার করলেন তিনি, ‘আমি জেনেছি যে উনি (ডমিঙ্গো) নাকি প্রধান নির্বাহীকে ই-মেইল করেছেন।’
তবে সেই ই-মেইলেও যে অনুশীলনের সূচি বদলাচ্ছে না, সেটির নিশ্চয়তাও দিয়ে রাখলেন আকরাম, ‘এমন নয় যে আমরা ওনার সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে কথা বলিনি। কিন্তু তিনি অনুশীলন শিবির শুরু করতে চেয়েছেন ১৬ নভেম্বর থেকে। আর খেলা শুরু ১৯ নভেম্বর। মাত্র তিন দিনের প্রস্তুতিতে পাকিস্তানের মতো দলের বিপক্ষে আপনি খেলতে নামবেন, এটা হয় নাকি?’ ডমিঙ্গোর দাবি যৌক্তিক মনে হয়নি বলেই যে নিজেরা অনুশীলন শিবির শুরুর দিন-তারিখ ঘোষণা করে দিয়েছেন, সেটিও জানাতে ভুললেন না আকরাম, ‘পাকিস্তান যে ছন্দে আছে, তাতে ওরা এই বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল তো অন্তত খেলবেই। এ রকম দলের বিপক্ষে অনুশীলন শিবিরের যে পরিকল্পনা দিয়েছিলেন ডমিঙ্গো, সেটি আমার কাছেই শুধু নয়, বোর্ডে আমার অন্য সহকর্মীদের কাছেও যুক্তিসংগত মনে হয়নি।’
বিশ্বকাপে আসার আগেই বোর্ডের সঙ্গে চুক্তির মেয়াদ আর বেতন, দুটিই বাড়ানোর কথা পাকা করে আসা ডমিঙ্গোর পায়ের নিচের শক্ত মাটিও তাতে এখন অনেকটা নরম হয়ে গেল। দলের পারফরম্যান্সের সঙ্গে যে ওঠা-নামা করে তাঁর গুরুত্বও!