সারা দেশে আগামীকাল বৃহস্পতিবার থেকে শুরু হচ্ছে সাত দিনের ‘কঠোর লকডাউন’। এই সময়ের মধ্যে অফিস-আদালত, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও সব ধরনের গণপরিবহন বন্ধ থাকবে। কিন্তু জরুরি পরিষেবার বাইরে শুধু রপ্তানিমুখী গার্মেন্ট শিল্প-কারখানা, বন্দর, আন্তর্জাতিক ফ্লাইট, খুবই সীমিত পরিসরে ব্যাংক ও কোরবানির হাট খোলা রাখার বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে। তবে স্বাস্থ্যবিধি ও নিয়ম-কানুন না মানলে গার্মেন্টও বন্ধ করে দেবে সরকার। কারখানার শ্রমিকদের কাছাকাছি অবস্থানে থেকে কাজে যোগ দেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করতে শিল্প মালিকদের বলা হয়েছে। বন্ধ থাকবে অভ্যন্তরীণ বিমান চলাচল।
গতকাল মঙ্গলবার রাতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নেতৃত্বে হওয়া সরকারের উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকে উপস্থিত একাধিক সূত্র কালের কণ্ঠকে এসব তথ্য জানিয়েছে। বৈঠকে মন্ত্রীদের মধ্যে তথ্যমন্ত্রী, স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা প্রতিমন্ত্রী, মন্ত্রিপরিষদসচিব, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব, জনপ্রশাসনসচিব, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সচিবসহ সেনাবাহিনী, বিজিবি, পুলিশের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
সভা সূত্রে জানা গেছে, জরুরি পরিষেবার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান ছোট গাড়ি চালাতে পারবে। গার্মেন্ট ফ্যাক্টরির শ্রমিকদের স্বাস্থ্যবিধি মেনে আনা-নেওয়া করতে হবে। তবে গার্মেন্ট ফ্যাক্টরির মালিক ও ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যুক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ছোট গাড়ি ব্যবহার করা যাবে না, তাদের হোম অফিস বা ফ্যাক্টরির ভেতরে থেকেই দায়িত্ব পালন করতে হবে। বৈঠক সূত্র জানিয়েছে, জরুরি সেবা ছাড়া মানুষ ঘর থেকে বের হতে পারবে না। অতীতের মতো কোনো মুভমেন্ট পাসও থাকছে না। কঠোর বিধি-নিষেধ বাস্তবায়নে পুলিশ, বিজিবি ও সেনাবাহিনীর টহলদলের সঙ্গে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট থাকবেন। যারা বিধি-নিষেধ মানবে না, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আজ বুধবার এই বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করা হবে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ডিজি সংক্রামক রোগ আইনের অধীনে সংশ্লিষ্টদের ক্ষমতা দেওয়ার বিষয়ে পৃথক আদেশ জারি করবেন বলে জানা গেছে।
সরকারের একটি সূত্র জানিয়েছে, কঠোর বিধি-নিষেধ না মানলে সংক্রামক রোগ (প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল) আইনের মাধ্যমে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
গত শনিবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নেতৃত্বে হওয়া উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকে কঠোর লকডাউনের মধ্যে জরুরি পরিষেবার সঙ্গে রপ্তানিমুখী গার্মেন্টশিল্প, কলকারখানা ও আন্তর্জাতিক ফ্লাইট খোলা রাখার বিষয়টিও আলোচনা হয়েছিল। সরকারের নীতিনির্ধারক পর্যায়ের দু-একজন কালের কণ্ঠকে বলেছেন, সরকার চাইছে কঠোর লকডাউন। কিন্তু ফ্লাইট চালু রেখে এবং গার্মেন্ট খোলা রাখলে ঢাকাসহ বড় শহরগুলোতে যথেষ্ট কড়াকড়ির সঙ্গে লকডাউন নিশ্চিত করা যাবে কি না তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।
সরকারের উচ্চ পর্যায়ের একটি সূত্র জানিয়েছে, লকডাউনে মুদির দোকান থেকে শুরু করে কোটিপতি ব্যবসায়ী—সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। সেখানে শুধু গার্মেন্ট ব্যবসায়ীদের ব্যবসার সুবিধার জন্য তাঁদের কারখানা খোলা রাখলে সরকার নৈতিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়বে। আবার বিশ্বব্যাপী চলমান লকডাউনের মধ্যেও গার্মেন্ট খাতে ভালো ব্যবসা করছে বাংলাদেশ। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের বড় এই খাতকে সুরক্ষা দেওয়া অর্থনীতির জন্যও প্রয়োজন। তাই সরকার এ বিষয়টিতে কী করবে, তা ঠিক করতে হিমশিম অবস্থায় রয়েছে।
গত বছর এপ্রিল ও মে মাসজুড়ে কঠোর লকডাউনের প্রথম দিকে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে জরুরি পরিষেবার সঙ্গে যুক্ত প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি ছাড়া সবাইকে ঘরে রাখতে অনেকটাই সফল হয়েছিল সরকার। কিন্তু এবার ঠিক সেইভাবে লকডাউন সফল করা সম্ভব কি না, তা নিয়ে চিন্তায় আছেন নীতিনির্ধারকরা। করোনার ঊর্ধ্বগতি সরকারকে বিরাট চিন্তায় ফেলে দিয়েছে। এর মধ্যে গত এক বছরের বেশি সময়ে বিভিন্ন মাত্রার লকডাউনের বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দ্রুত সিদ্ধান্ত বদলাতে হয়েছে সরকারকে। এরই মধ্যে লকডাউন বিষয়ে জনমনে বিরূপ প্রভাবও পড়েছে। বিশেষ করে অফিস-আদালত খোলা রেখে গত তিন দিনের লকডাউনে মানুষের বিরক্তি ও ভোগান্তি গণমাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছে।
এদিকে সরকারি বিধি-নিষেধ জারির সঙ্গে যুক্ত উচ্চ পর্যায়ের একাধিক সূত্র কালের কণ্ঠকে জানিয়েছে, কঠোর লকডাউন না মানলে সংক্রামক রোগ (প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল) আইনের মাধ্যমে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। গত বছর দেশে করোনা সংক্রমণের পরিপ্রেক্ষিতে উল্লিখিত আইনের ১১(১) ধারার ক্ষমতাবলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তৎকালীন মহাপরিচালক আবুল কালাম আজাদ সারা দেশকে করোনাভাইরাসের জন্য ‘ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা’ হিসেবে ঘোষণা করেন। করোনা সংক্রমণ বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে ২০১৮ সালে জারি করা এই আইনকে মোবাইল কোর্ট আইনের তফসিলেও যুক্ত করা হয়।
সংক্রামক রোগ আইনের ২৫(১) ধারা অনুযায়ী, ‘যদি কোনো ব্যক্তি—মহাপরিচালক, সিভিল সার্জন বা ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে তাহার উপর অর্পিত কোনো দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে বাধা প্রদান বা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেন, এবং সংক্রামক রোগ প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূলের উদ্দেশ্যে মহাপরিচালক, সিভিল সার্জন বা ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্মকর্তার কোনো নির্দেশ পালনে অসম্মতি জ্ঞাপন করেন, তাহা হইলে উক্ত ব্যক্তির অনুরূপ কার্য হইবে একটি অপরাধ।’ আইনের ২৫(২) অনুযায়ী, ‘যদি কোনো ব্যক্তি উপধারা (১)-এর অধীন কোনো অপরাধ সংঘটন করেন, তাহা হইলে তিনি অনূর্ধ্ব ৩ (তিন) মাস কারাদণ্ডে, বা অনূর্ধ্ব ৫০ (পঞ্চাশ) হাজার টাকা অর্থদণ্ডে বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হইবেন।’
এই আইনের ৩০ ধারা অনুযায়ী, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক প্রয়োজনে, লিখিত সাধারণ বা বিশেষ আদেশ দ্বারা তাঁর উপর অর্পিত কোনো ক্ষমতা অধিদপ্তরের যেকোনো কর্মকর্তাকে অর্পণ করতে পারেন। এর বাইরে আইনটি মোবাইল কোর্টের অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় সারা দেশে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের মাধ্যমেও ওই শাস্তি দেওয়ার সুযোগ আছে। চলমান লকডাউনে সিটি করপোরেশন ও জেলা-উপজেলা থেকে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা এই আইনের ক্ষমতাবলে মোবাইল কোর্ট পরিচালনার মাধ্যমে আইন লঙ্ঘনকারীদের নমনীয় শাস্তিও দিচ্ছেন। তবে কাল থেকে শুরু হতে যাওয়া লকডাউনে শাস্তি ও জরিমানা তুলনামূলক কঠোর বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।