নিরাপদ পানির আশায় সাব মার্সিবাল গভীর নলকূপ স্থাপন করেন ব্যবসায়ী শফিউল আলম বাবু। কিন্তু ওই নলকূপ থেকে মিলছে গরম পানি। তাও আবার ফুটন্ত পানির মতোই। শুরুর দিকে হালকা মনে হলেও এখন পানি বেশ গরম অনুভুত হচ্ছে। একারণে সেই পানি হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখতে প্রতিদিন বিভিন্ন এলাকার মানুষজন সেখানে ভিড় করছেন।
স্থানীয়রা বলছেন, ২৫ ফুটের বেশি গভীর হলেই নলকূপ দিয়ে গরম পানি বের হচ্ছে। বাবুর বাড়ি ছাড়াও গ্রামের অন্তত ছয়-সাতটি বাড়ির টিউবওয়েল থেকে গরম পানি মিলছে। কিন্তু বাবুর নলকূপ থেকে পাওয়া পানির মতো গরম নয়। চা খাওয়ার জন্য যতটুকু গরম পানি লাগে, নতুন ওই নলকূপ থেকে সে রকমই গরম পানি উঠছে। পাঁচ থেকে দশ মিনিট পর হলেই গরম পানির উত্তাপে টিউবওয়েলের প্লাষ্টিক পাইপে হাত রাখা দায়।
শুনে আশ্চর্যজনক মনে হলেও ঘটনাটি সত্য। তবে কেন এবং কি কারণে নলকূপ থেকে গরম পানি বের হচ্ছে, এর কারণ এখনো জানা যায়নি। সাড়া ফেলানো এ ঘটনাটি ঘটেছে রংপুর জেলার সদর উপজেলার চন্দনপাট ইউনিয়নের মন্ডলপাড়া গ্রামে। সেখানকার চাল ব্যবসায়ী শফিউল আলম বাবু তার বাসার সামনে ৭ মাস আগে ওই নলকূপটি স্থাপন করেন।
সরেজমিনে মন্ডলপাড়া গ্রামে গেলে চোখে পড়ে বাবুর বাড়ীর সামনে কিছু উৎসুক মানুষের ভিড়। তারা ওই গভীর নলকূপ থেকে বের হওয়া গরম পানি নিজ হাতে ছুঁয়ে দেখছেন। আবার কেউ কেউ তা বিভিন্নপাত্রে ভরিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। বাসার মালিক বাবু ও তার স্ত্রী আদুরী বেগম ওই নলকূপের পানি ব্যবহার করেন না। এই সমস্যা শুধু তাদের নলকূপেই নয়। গ্রামের বেশ কিছু নলকূপ দিয়েই এমন গরম পানি বের হয় বলে দাবি স্থানীয়দের।
গ্রামে কৃষি কাজ করেন আব্দুস সালাম। কাজ শেষে ফুটন্ত গরম পানিতে হাত ধুয়ে নেন এই বৃদ্ধ। এসময় তিনি বলেন, বাবু তার বাসা নির্মাণ কাজের সময়ে গভীর নলকূপটি স্থাপন করেন। বিদ্যুৎচালিত ওই নলকূপটি চালু করলে প্রথম চার-পাঁচ মিনিট হালকা গরম পানি বের হয়। কিন্তু পাচঁ-দশ মিনিট পর ফুটন্ত গরম পানির মতো পানি বের হতে থাকে। একারণে নির্মাণ শ্রমিকরা নলকূপের পানি ব্যবহার করেনি।
একই গ্রামের জুয়েল ইসলাম নামে এক যুবক জানান, নলকূপটির সুইচ চালু করার কিছুক্ষণ যেতে না যেতেই বৈদ্যুতিক মটর মেশিনটি গরম হতে থাকে। একই সঙ্গে নলকূপ থেকে গরম পানিও বের হয়। কিন্তু একই জায়গাতে আগে আরো একটি নলকূপ ছিল, সেখান থেকে স্বাভাবিক গরম পানি বের হতো। অথচ নতুন নলকূপের পানি অনেকটা গরম চায়ের পানির মতো গরম। অজানা আতঙ্কে এই নলকূপের পানি কেউ ব্যবহার করছে না।
আমিনুল ইসলাম নামের একজন বলেন, ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছি আমাদের গ্রামের নলকূপ থেকে গরম পানি বের হচ্ছে। কিন্তু বাবুর বাড়ির নলকূপের পানির মতো এতোটা গরম নয়। তবে সাবানের পানির মতো এই পানি অনেকটা পিচ্ছিল। এটার গন্ধটাও একটু অন্যরকম। এখানকার মাটি ও পানি পরীক্ষা করলে প্রাকৃতিক গ্যাস বা খনিজ সম্পদের সন্ধানও মিলতে পারে বলে ধারণা তার।
শফিউল আলম বাবু চন্দনপাট ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের মন্ডলপাড়া গ্রামের মৃত আব্দুল করিম মন্ডলের ছেলে। পেশায় তিনি ব্যবসায়ী। পাশাপাশি আওয়ামী লীগের রাজনীতি করেন। স্ত্রী, দুই ছেলে ও এক মেয়ে সন্তান নিয়ে তার পরিবার। গত বছর তিনি বাড়ি নির্মাণ কাজের সময়ে গভীর নলকূলটি স্থাপন করেন।
এব্যাপারে তার স্ত্রী আদুরী বেগম জানান, সুপেয় ও নিরাপদ ঠান্ডা পানি উত্তোলনের আশায় উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অফিসের মাধ্যমে এবছরের ৭ ফেব্রুয়ারি ৫৪৫ ফুট গভীর সাব মার্সিবাল গভীর নলকূপটি স্থাপন করেন। কিন্তু ঠান্ডা পানির বদলে সেখান থেকে গরম পানি বের হচ্ছে। এখানে যতো গভীরে নলকূপ স্থাপন করা যাবে, ততো বেশি গরম পানি মিলবে।
নতুন নলকূপ থেকে প্রথম কয়েকদিন ঠান্ডা পানি বের হয়েছিল। এরপর ওই নলকূপ থেকে গরম পানি বের হওয়া শুরু হয়। এ থেকে পরিত্রাণ পেতে আরো দুইটি নলকূল বসানো হয়েছে। তবু পানির কোনো পরিবর্তন হয়নি। তবে বাসার ভিতরে বসানো ১৯৫ ফুট গভীর নলকূপের পানি কুসুম কুসুম গরম। সেই পানি দিয়ে রান্নাবান্নাসহ অন্যান্য কাজ করা হয়। কোনো সমস্যা মনে হচ্ছে না। কিন্তু বাসার বাহিরে বসানো নতুন নলকূপটির গভীরতা বেশি হওয়াতে পানিও একটু বেশি গরম।
স্থানীয় বাসিন্দারা দ্রুত এই গরম পানির রহস্য বা অজানা কারণ জানতে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর ছাড়াও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সরেজমিন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার দাবি জানিয়েছেন।
চন্দনপাট ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আমিনুর রহমান বলেন, প্রথম দিকে বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে নেয়া হয়নি। তখন মনে হয়েছিল, নতুন নলকূপ থেকে একটু গরম পানি বের হওয়াটা স্বাভাবিক। কিন্তু দিন দিন সেই পানি তীব্র থেকে তীব্র গরম হচ্ছে। একারণে সবার মধ্যে এক ধরণের শংকা কাজ করছে। মানুষের মধ্যে একদিকে আতঙ্ক বিরাজ করছে, অন্যদিকে সম্ভাবনাময় খনিজ সম্পদের বিষয়টিও ভাবিয়ে তুলেছে। আমি বিষয়টি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের জানিয়েছি।
উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অফিসের কর্মকর্তা সরকার সাব্বির আহমেদ বলেন, ঘটনা অপ্রত্যাশিত। গভীর নলকূপ ও আশেপাশের নলকূপ থেকে গরম পানি বের হচ্ছে। উর্ধতন কর্তৃপক্ষ সহ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে পানি পরীক্ষা করা হয়েছে। গরম ও গন্ধ থাকলেও পানি খাবার উপযোগী রয়েছে বলেও জানান তিনি।
এ বিষয়ে জনস্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রংপুর পানি পরীক্ষাগারের রসায়নবিদ (কেমিস্ট) আব্দুল জব্বার বলেন, আমরা বৃহস্পতিবার ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছি। সেখানকার পানি পরীক্ষা করে ৪১ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা পেয়েছি৷ তবে কেন, কিভাবে এটি হলো তা বলা মুশকিল। জিওলজিক্যাল কোন কারণে এটি হতে পারে। সেক্ষেত্রে হাইড্রোলিওজিস্ট অথবা মাইনিং স্পেশালিষ্ট কাউকে দিয়ে পরীক্ষা করা হলে কারণ বের হতে পারে। আমরা উপর মহলে কথা বলে সে চেষ্টা করছি।
রংপুর জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী পঙ্কজ কুমার সাহা বলেন, ‘রংপুরে এটি নতুন সমস্যা। জিওলজিক্যাল সমস্যার কারণে এটি হতে পারে। আমরা বিষয়টি গ্রাউন্ড ওয়াটার সার্কেল কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি।