‘চোখের সামনোত চেনা মুখগুলা আসি পেট্রল দিয়া বাড়িত আগুন ধরি দিল। ঘরোত ঢুকি টাকা, সোনাদানা, লুট করি নিল। হামার কষ্টের সংসারের সউগ শ্যাষ হয়্যা গেইল বাহে…।’
কাঁদতে কাঁদতে বলছিলেন রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার রামনাথপুর ইউনিয়নের বড়করিমপুর মাঝিপাড়ার উজালি রানী। রবিবার রাতে উজালি রানীর বাড়িসহ মাঝিপাড়ার ২৫টি বাড়িতে আগুন দেওয়া হয়। এই বাড়িগুলোসহ ৬০ পরিবারের বসতবাড়িতে ভাঙচুর করা হয়।
স্থানীয় এক হিন্দু তরুণ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ধর্মের অবমাননা করেছেন—এমন অভিযোগ তুলে আশপাশের গ্রামের শতাধিক মানুষ এ হামলা চালায়।
এ ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে গতকাল সোমবার সন্ধ্যায় পৃথক দুটি মামলা করেছে। আসামি করা হয়েছে অজ্ঞাতপরিচয় পাঁচ শতাধিক লোককে। গ্রেপ্তার করা হয়েছে ৪৫ জনকে। এ ছাড়া হামলার সময় লুট করা তিনটি গরু উদ্ধার করা হয়েছে।
রংপুরের এসপি বিপ্লব কুমার সরকার জানিয়েছেন, যে তরুণের ফেসবুক স্ট্যাটাস ঘিরে সহিংসতা ছড়ায়, তাঁকে জয়পুরহাট থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
সরেজমিনে গিয়ে জানা গেছে, রবিবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার পর হামলা-লুটপাট শুরু হয়। খবর পেয়ে প্রশাসনের লোকজন উপস্থিত হওয়ার আগেই ২৫টি বাড়ি পুড়ে ছাই হয়ে যায়। গতকাল সকালে মাঝিপাড়ায় গিয়ে দেখা গেছে, আগুনে পোড়া বাড়ির সব বাসিন্দাই দরিদ্র। সুভাষ চন্দ্র, সুবর্ণ রায়, সুধারামসহ অনেকে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলেন।
বাসিন্দারা জানায়, ধর্মীয় স্লোগান দিতে দিতে হামলা চালানো হয়। হামলাকারীরা সংখ্যায় ছিল শতাধিক। তাই প্রতিরোধের কোনো চেষ্টা না করে বাড়ির লোকজন পাশের ধানক্ষেতে লুকিয়ে পড়ে। হামলাকারীরা একের পর এক বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। লুট করে টাকা, মূল্যবান মালপত্র। কারো কারো গবাদি পশুও পাওয়া যাচ্ছে না।
প্রদীপ চন্দ্র বলেন, ‘রাতে শত শত মানুষ বাড়িতে ঢুকে পড়ে। পরিবারের অন্য সদস্যদের নিয়ে ভয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে যাই। হামলাকারীরা ঘরে থাকা ২৫ হাজার টাকাসহ মূল্যবান মালপত্র নিয়ে গেছে। যাওয়ার সময় বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়।’
ননী গোপাল জানান, তিনি ঘটনার সময় রাধাগোবিন্দমন্দিরে পূজা করছিলেন। হঠাৎ বিপুলসংখ্যক মানুষ এসে বাড়ি ও মন্দিরে ঢুকে আগুন ধরিয়ে দেয়।
ক্ষুব্ধ বিলাস চন্দ্র বলেন, শেষ পর্যন্ত সবাই এলো, কিন্তু সব কিছু শেষ হওয়ার অনেক পরে। তিনি জানান, হামলাকারীরা পূর্ণিমা রানীর বাড়িতে ঢুকে ৫০ হাজার টাকা ও একটি গরু নিয়ে গেছে।
গতকাল গ্রামটিতে গেলে টহল দিতে দেখা গেল পুলিশ, র?্যাব ও বিজিবির সদস্যদের। ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন বিভাগীয় কমিশনার আবদুল ওহাব ভূইয়া, পুলিশের রেঞ্জ ডিআইজি দেবদাস ভট্টাচার্য, জেলা প্রশাসক আসিব আহসান, বিজিবির কর্মকর্তা, জেলা ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ এবং জেলা পূজা উদযাপন কমিটির নেতারা। তাঁরা ক্ষতিগ্রস্তদের ন্যায়বিচারের আশ্বাস এবং ক্ষতিপূরণসহ স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার সব ধরনের সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দেন।
জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাৎক্ষণিক চাল, ডাল, তেল, লবণ, চিনিসহ খাদ্যসামগ্রী, ১০০ বান্ডেল ঢেউটিন ও পরিবারপ্রতি ১০ হাজার টাকা সহযোগিতা দেওয়া হয়।
এ হামলার প্রতিবাদ জানিয়ে রংপুর নগরে বিক্ষোভ সমাবেশ করেছে জেলা ও মহানগর ছাত্রলীগ, মহানগর পূজা উদযাপন পরিষদসহ বিভিন্ন সংগঠন। তারা ওই হামলার জন্য জামায়াত-শিবিরকে দায়ী করে অবিলম্বে জড়িত ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার করে বিচারের আওতায় আনার দাবি জানায়।
নাটোরে মূর্তি ভাঙচুর : রবিবার রাতে নাটোরের লালপুরের দৈবকী শিব ও কালীমন্দিরের শীতলামন্দিরে থাকা শীতলা মূর্তির গলা কেটে বিচ্ছিন্ন করেছে দুর্বৃত্তরা। খবর পেয়ে গতকাল সকালে নাটোরের জেলা প্রশাসক শামীম আহমেদ, পুলিশ সুপার লিটন কুমার সাহাসহ পুলিশ ও প্রশাসনের কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন এবং এ ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের আইনের আওতায় আনার আশ্বাস দেন
ফেনীতে মোট গ্রেপ্তার ৬ : শনিবার রাতে ফেনী শহরের কালীপাল গাজীগঞ্জ মহাপ্রভুর আশ্রম, ট্রাংক রোড ও কালীমন্দিরে হামলা-ভাঙচুরের ঘটনায় আরো তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এর আগে র্যাব পৃথক অভিযান চালিয়ে তিনজনকে গ্রেপ্তার করে। ওই ঘটনায় র্যাবের পক্ষ থেকে একটি এবং পুলিশের পক্ষ থেকে দুটি মামলা করা হয়। এদিকে গতকাল চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি আনোয়ার হোসেন ফেনীতে হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত মন্দির ও আশ্রম পরিদর্শন করেন।
নোয়াখালীতে গ্রেপ্তার আরো ৫ : গত শুক্রবার জুমার নামাজের পর নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলার চৌমুহনী বাজারে রাম ঠাকুরের আশ্রম, ইসকন মন্দিরসহ কয়েকটি মন্দিরে হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও দোকানপাট ভাঙচুরের সময় পুলিশের ওপর হামলার ঘটনায় আরো পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।