বাংলা ভাষায় একটি প্রবাদ আছে, ‘মায়ের চেয়ে মাসির দরদ বেশি’। এই ব্যাপারটি এখন বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে, বিভিন্ন অবস্থানে দেখা যায়। বিভিন্ন ক্লিনিকের দালাল চক্র উক্ত প্রবাদটি একদমই করায় গণ্ডায় পালন করছে। দেখা যাচ্ছে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নিতে ময়মনসিংহে গর্ভবতী নারীদের স্বামীর থেকে বেশি খবর রাখেন ক্লিনিক মালিকের দালাল চক্র। এদের রয়েছে অগনিত সোর্স। এমন চিত্র রাজধানী ঢাকা সহ দেশের বিভিন্ন স্থানে।
আমাদের বিশেষ প্রতিনিধি শুধু ময়মনসিংহ জেলা ঘুরে একটি তথ্য তৈরি করেছেন। সেখানে দেখা গেছে ময়মনসিংহ জেলা ও উপজেলাগুলিতে গড়ে তোলা হয়েছে প্রায় ৭শ’ ক্লিনিক। যেখানে গর্ভবতী নারীদের সিজার অপারেশন করা হয় বেশি। এসব ক্লিনিকের মধ্যে মাত্র ২ শত রয়েছে অনুমোদন। বাকীরা জেলা সিভিল সার্জনের কাছে অনুমতি চেয়ে আবেদন করেই ক্লিনিক ব্যবসা শুরু করেন।
নাম সর্বস্ব অনুমতি-বিহীন এসব ক্লিনিক মালিকদের নিয়োজিত দালালরা নারীরা গর্ভবতী হয়েছেন কিভাবে তা বিশেষ শোর্শের মাধ্যমে জেনে যান। আবার সরকারি হাসপাতালে আসা গর্ভবতী নারীদের তাদের ক্লিনিকে নিতে দৌড়ঝাঁপ শুরু করে। ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে ওঠা এসব ক্লিনিক কর্তৃপক্ষ গর্ভবতীদের ভাগিয়ে নিতে এসব দালাল নিয়োগ করেছে। দালালরা গর্ভবতী নারীকে অথবা আত্মীয়-স্বজনদের কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে পরামর্শ দেন। ক্লিনিকে ভর্তির পর নতুন গর্ভবতীর খোঁজে ক্লিনিক ত্যাগ করে আবারো নতুন গর্ভবতী খোঁজেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ৫ মাসের গর্ভবতী নারীরা ১০ মাসে কখন সিজার হবে তা তারা (দালাল ও ক্লিনিক মালিক) জানেন। অনেক সময় গর্ভবতীর স্বামীরাও জানেন না। অথচ তারা জানেন সোর্সদের মাধ্যমে। এরপর গর্ভবতীদের বাসায় যান। প্রাথমিক চিকিৎসা দেন। ফল-মূল, পথ্য কিনে দেন। ইসলামী শরিয়তের কথা, মিথ্যা অভিজ্ঞতার বুলি আওড়ান। বিভ্রান্ত ছড়ান। এমনসব অভিজ্ঞতার বর্ণনা দেন যা ক্ষোদ ডাক্তাররাও জানেন না। এসব হাতুড়ে নামধারী ডাক্তার , ক্লিনিক মালিক দালালরা মিলে ১০ হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে গর্ভবতী নারীদের সিজার করিয়ে।
জানা যায়, সরকারি হাসপাতালে সিজারিয়ান অস্ত্রোপচার, এক্সরে, ইসিজিসহ ক্লিনিক্যাল সব ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার ব্যবস্থা থাকলেও এসব ক্লিনিকে নিতে দালালরা মিথ্যা প্রলোভন দেখায়। এতে রোগীরা দালালদের খপ্পরে পড়ে ক্লিনিকে চলে যায়। ফলে প্রতারণা ও বাড়তি টাকা হাতিয়ে নেয় ক্লিনিক কর্তৃপক্ষ, দালাল ও তাদের সোর্স চক্র। এরা গর্ভবতী নারী ও তাদের আত্মীয়- স্বজনদের বলে, সরকারি হাসপাতালে পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয় না। তারা হাসপাতালে যন্ত্রপাতি নষ্ট বলেও অপপ্রচার করে। নিজেদের ক্লিনিকে নিয়ে গিয়ে নামসর্বস্ব পরীক্ষার প্রতারণা করে। ক্লিনিকে নিয়োজিত ডাক্তারদের হেলপার হিসাবে কিছুদিন কাজ করে সামান্য অভিজ্ঞ হয়ে নিজেরাই সিজার অপারেশন বা অস্ত্রোপচার করছে এই ভুয়া-চক্র। এদের ক্লিনিক থেকে আলটাসনোগ্রাম রিপোর্টে ছেলের স্থলে মেয়ে আবার মেয়ের স্থলে ছেলে ভ্রূণ বা শিশু দেয়া হয়। এতে পারিবারিক কলহও দেখা দেয় গর্ভবতীর পরিবারের। কখনও কখনও বিচ্ছেদের ঘটনাও ঘটে।
সংশ্লিষ্ট অভিজ্ঞ মহল জানান, প্রাকৃতির নিয়মে সবচেয়ে আদিম উপায় হচ্ছে ভেজাইনাল ডেলিভারি। এই উপায়ে সন্তান বর্থ ক্যানেলে অর্থাৎ যোনিনালী দিয়ে মাতৃগর্ভ থেকে বের হয়। গ্রাম গঞ্জে বেশিরভাগ এ প্রক্রিয়ায় গর্ভধারণের ৩৮ থেকে ৪১ সপ্তাহের মধ্যে সন্তান প্রসব করেন। এসব শিশুর রোগবালাই সংক্রমণের মাত্রা কম হলেও সন্তান প্রসবের সময় প্রচুর ব্যথা হয় মায়েদের। এই ব্যথার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে এবং বিভ্রান্ত করে এইসব ক্লিনিক কর্তৃপক্ষ মালিক, দালাল ও সোর্সরা গর্ভবতী ও আত্মীয় – স্বজনদের রীতিমত ভয় দেখান। মায়ের এবং শিশুর ক্ষতি হবে এমন আতঙ্কেও কথা বলেন। বাধ্য হয়েই তারা ক্লিনিকের শরণাপন্ন হন।
এসব ক্লিনিকে সিজারিয়ানের মাধ্যমে সন্তান প্রসবের রয়েছে প্যাকেজ। একদিন থেকে তিনদিন। এক সপ্তাহ। রেট ১০ হাজার টাকা থেকে ৫০ হাজার টাকা কখনও কখনও আরো বেশি। ময়মনসিংহের মহানগর, ভালুকা, ত্রিশাল, হালুয়াঘাট, ফুলপুর,মুক্তাগাছা ও ভালুকা গর্ভবতীদের ভয় দেখিয়ে অনেক ক্লিনিকে সিজারিয়ানে বাধ্য করা হয় বলে অভিযোগ উঠেছে। এসব ক্লিনিক সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের তদারকি নেই। নেই অনুমোদন। ক্লিনিকের নামে কসাইখানা।
অভিযোগ রয়েছে, ভালুজা উপজেলার মাস্টার-বাড়ি ক্লিনিকে তিন ছেলে সন্তানের জননী গর্ভবতী আর্জিনা বেগম ২ বার আলট্রাসনোগ্রাম করেন। দুই রিপোর্টেই আসে ছেলে। মহিলার আলট্রাসনোগ্রাম রিপোর্ট থেকে তার সংসারে দ্বন্দ্ব হয়। তার প্রতি তার স্বামীর বিদ্বেষ দেখা দেয়। স্বামী তাকে এবং সন্তানদের রেখে ছেড়ে চলে যান। আর্জিনা বেগম নিজেকে রক্ষায় এবার ময়মনসিংহ গিয়ে শহরের নিউ মেডিকেয়ার নামের একটি ক্লিনিকে আলট্রানোগ্রাম করান। এতে রিপোর্ট আসে তার গর্ভে মেয়ে। নিউ মেডিকেয়ার কর্তৃপক্ষ বলেন,এসব অখ্যাত ক্লিনিকরাই ডুবিয়েছে। ময়মনসিংহের সাদিয়া ক্লিনিকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক
শাহিনুর রহমান জানান, আমরা ভাল সেবা দিয়ে টাকা নেই। কোন প্রতারণা করি না। ময়মনসিংহ জেলা সিভিল সার্জন ডাক্তার মোঃ নজরুল ইসলাম বিডি২৪লাইভকে জানান,আমরা আগেও অভিযান চালিয়েছে জরিমানা করেছি। খুব শীঘ্রই অভিযান চালিয়ে অবৈধ ক্লিনিক বন্ধ করে দেয়া হবে। ময়মনসিংহ জেলা জজ কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এড. নজরুল ইসলাম চুন্নু বিডি২৪লাইভকে জানান, ময়মনসিংহের ক্লিনিক মালিকরা সেবার চেয়ে প্রতারণা করছে বেশি। তারা গরীব মানুষদের সাথে প্রতারনা মাধ্যমে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নেয়। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন।