সিজারিয়ান করানো খুব সাধারণ ব্যাপার আজকাল। মায়েদের গর্ভাবস্থায় কোন জটিল সমস্যা সৃষ্টি হলে চিকিৎসকরা সিজারের পরামর্শ দেন। আবার অনেকের অভিযোগ চিকিৎসকরা টাকার জন্যই বেশি বেশি সিজার করেন। এসব বিষয় নিয়ে মেডিকেলবিডি’র সাথে দেশ ও দেশের বাইরের অভিজ্ঞতা শেয়ার করেছেন ডেলটা মেডিকেল কলেজের অবস অ্যান্ড গাইনী বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. নুসরাত জাহান।
নরমাল ডেলিভারি বলতে আমরা কী বুঝি?
ডা. নুসরাত জাহান: গর্ভের বাচ্চা পৃথিবীতে ভূমিষ্ঠ হবার জন্য সৃষ্টিকর্তার প্রদত্ত পথে যে ডেলিভারি হয় সেটাই হচ্ছে নরমাল ডেলিভারি। যদি কোন কারণে এই পথ বাধাগ্রস্ত হয় তবে আমরা বাচ্চাকে সিজারের মাধ্যমে ডেলিভারি করি।
নরমাল ডেলিভারির সুবিধা কী?
ডা. নুসরাত জাহান: এটি সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত ব্যবস্থা, তাই প্রশ্নাতীতভাবে এই প্রসেস মা এবং বাচ্চা উভয়ের জন্যই উত্তম। এখানে মা অজ্ঞান হবার ঝুঁকি থেকে মুক্ত থাকে, উপরন্তু সিজারের মাধ্যমে মায়ের পেটে যে এডহেশন তৈরি হয় সেটাও এখানে হয় না। নরমাল ডেলিভারি সময় বাচ্চাকে অনেক সংগ্রাম করে আসতে হয়, ফলে এই বেবীরা পরবর্তীতে কষ্টসহিষ্ণু হয় অর্থাৎ এদের জন্মের পর শ্বাসকষ্টের প্রবলেম কম থাকে এবং ইম্যুনিটি বা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি থাকে।
আপনি তো সৌদি আরবে ছিলেন, ওখানকার ডেলিভারির অবস্থা সম্পর্কে কিছু বলুন।
ডা. নুসরাত জাহান: আমি সৌদি আরবের নাজরান প্রদেশে “মেটানিটি অ্যান্ড চিলড্রেন হসপিটাল” এ কাজ করেছি। এখানে বিভিন্ন জায়গা থেকে রেফারেল রোগীরা আসতো এবং প্রতিদিন গড়ে ২৫ থেকে ৩০টি নরমাল ডেলিভারি হতো, অন্যদিকে সিজার হতো মাত্র চার থেকে পাঁচটি, যা বাংলাদেশের নরমাল ডেলিভারি এবং সিজার এর আনুপাতিক হারের ঠিক অপজিট।
আপনি সৌদি আরবে কেনো গেলেন? সেখান থেকে দেশে ফিরে আসার কারণ কী?
ডা. নুসরাত জাহান: আমি এমবিবিএস পাশ করার পর পরই সৌদি আরবে চলে যাই। সেখানে আমার হাজবেন্ড আগে থেকেই ছিল। আমি সেখানে একটি টারশিয়ারি লেভেল হসপিটালে কাজ করেছি। সেই অভিজ্ঞতা আমার পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন ট্রেনিং হিসেবে কাউন্ট হয়েছিল। ফলে বাংলাদেশে ফিরে এসে অল্প সময়ের মধ্যেই আমি এফসিপিএস পরীক্ষা দিতে পেরেছিলাম।
বর্তমানে যারা চাকরির জন্য সৌদি আরব যেতে চান তাদের করণীয় কী? সেখানে তাদের জন্য কী কী সুযোগসুবিধা রয়েছে?
ডা. নুসরাত জাহান: আমি মনে করি দেশের বাইরে একজন ডাক্তার শুধু যে অর্থনৈতিকভাবে ভালো থাকে তাই নয়, সে অনেক সম্মানও পায়। তাছাড়া পেশেন্ট ম্যানেজমেন্ট এর ক্ষেত্রেও তারা অনেক লজিক্যাল এবং স্পেসিফিক হবে। কারণ বাহিরে পেশেন্ট ম্যানেজমেন্ট এর ক্ষেত্রে একটি নির্দিষ্ট প্রটোকল ফলো করা হয়, যা আমাদের দেশে হয় না। আমার মনে আছে, আমি একবার আট ঘন্টা ডিউটি শিফটে ১৩ টি নরমাল ডেলিভারি করিয়েছি। যা আমাদের দেশের অনেক হসপিটালে এক মাসেও সম্ভব হয় না। তবে যারা বাইরে যেতে চায় তাদের জন্য আমার উপদেশ হলো, যেখানেই যান পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন করার বিষয়টা সবার আগে প্রাধান্য দিতে হবে।
সৌদি আরবের রোগী এবং ডাক্তাররা কী ধরনের সুবিধা পেয়ে থাকেন, যা আমাদের দেশের তুলনায় আলাদা?
ডা. নুসরাত জাহান: ওখানে রোগীরা সরকার থেকে সকল ধরনের সুযোগ সুবিধা বিনামূল্যে পেয়ে থাকেন। মা এমন বাচ্চার অবস্থা দেখার জন্য সকল ধরনের সুবিধা আমাদের হাতের নাগালেই ঠিকই ছিল যেমন প্রত্যেক রোগীর জন্য একটি সিটিজি মেশিন থাকত, যার মাধ্যমে গর্ভস্থ বাচ্চার হার্টবিট ইসিজির মত রেকর্ড করা যায়, যা আমাদের দেশে অনেক বড় হসপিটালে একটিও দেখা যায় না। এছাড়া বেডসাইড আল্ট্রাসনোগ্রাম, সার্বক্ষণিক স্পেশালিস্ট ডাক্তারের মাধ্যমে ইমার্জেন্সি সিজারিয়ানের সুবিধার কারণে রোগীর ম্যানেজমেন্ট অনেক সুবিধাজনক ছিল।
আমাদের দেশে সিজার এত বেশি হওয়ার কারণ কী? অনেক রোগীর ধারণা টাকার জন্যই ডাক্তাররা বেশি বেশি সিজার করেন।
ডা. নুসরাত জাহান: কিছু কিছু ক্ষেত্রে হয়ত টাকার ভূমিকা আছে তা অস্বীকার করা যাবে না, কারণ আমাদের দেশে ডাক্তারদের বেতন উন্নত দেশের মতো না। তবে সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধার অভাব। দক্ষ লোকবল এবং উন্নত প্রযুক্তি না থাকায় অনেক ডাক্তারই এত সময় দিতে পারেন না এবং রিস্ক নিতে চান না।
এই ব্যাপারে আপনার প্র্যাকটিক্যাল এক্সপেরিয়েন্স কেমন?
ডা. নুসরাত জাহান: আমি একটি প্রাইভেট মেডিকেল কলেজে আছি, যেখানে বেশিরভাগ রোগী মধ্যবিত্ত ও উচ্চ মধ্যবিত্ত শ্রেণীর। এদের মধ্যে সিজারের প্রবণতা বেশি দেখা যায়। এর কারণ হচ্ছে যখন তারা দেখে তাদের চারপাশে (নরমাল ডেলিভারির) ব্যথা ছাড়াই সিজারের মাধ্যমে বাচ্চা ডেলিভারি হয়ে যাচ্ছে, তখন তারা এ ব্যাপারে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। তবে যাদের শেষ পর্যন্ত নরমাল ডেলিভারির মাধ্যমে বাচ্চা হয়েছে তারা খুবই হ্যাপি ফিল করে।
বর্তমানে বাংলাদেশে ব্যথামুক্ত নরমাল ডেলিভারি শুরু হয়েছে। এটার সুফল কী?
ডা. নুসরাত জাহান: এটা খুবই পজেটিভ একটা দিক। কারণ, যে মায়েরা ব্যথা সহ্য করার ভয়ে নরমাল ডেলিভারি করতে চাইতো না, তারা এখন এ ব্যাপারে উৎসাহী হবেন।
ব্যক্তিগতভাবে আপনি রোগীদের কীভাবে উৎসাহিত করেন?
ডা. নুসরাত জাহান: আমি আমার সব রোগীদের এর সুবিধার কথা বলি। আমি যেখানে এখন কর্মরত আছি সেখানে নরমাল ডেলিভারি করার জন্য মোটামুটি ভালো সুবিধা পাই। আমার সহযোগী যে ডাক্তাররা আছে তারাও এ ব্যাপারে বেশ পারদর্শী। তাছাড়া আমার একটি ব্যক্তিগত সিটিজি মেশিন আছে যা আমি হাই রিস্ক পেশেন্টদের মনিটরিংয়ের ক্ষেত্রে ইউজ করতে পারি। ডাক্তার হিসেবে আমি মনে করি নরমাল ডেলিভারির মাধ্যমে একটি সুস্থ বাচ্চা জন্মদানে সাহায্য করায় যে তৃপ্তি সেটা অন্য কোথাও নেই।
আপনার একাডেমিক হিস্ট্রি আমাদেরকে সংক্ষেপে বলুন।
ডা. নুসরাত জাহান: আমি শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ থেকে ২০০২ সালে এমবিবিএস পাস করি। এরপর ২০০৮ এ এমআরসিওজি (লন্ডন) পার্ট ওয়ান করি এবং ২০১০ সালে অবস-গাইনীতে এফসিপিএস ডিগ্রী লাভ করি। এরপর কলকাতার প্রসিদ্ধ ইনফার্টিলিটি স্পেশ্যালিস্ট বিএন চক্রবর্তীর তত্ত্বাবধানে ইনফার্টিলিটির উপরে ট্রেনিং করেছি। এছাড়া বাংলাদেশ থেকে ল্যাপারোস্কোপিক সার্জারি এবং কলপোস্কপির উপরেও আমার ট্রেনিং রয়েছে।